অসভ্যদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেল ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির (১৮)। উন্নত চিকিৎসার জন্য তার আর সিঙ্গাপুরে যাওয়া হলো না। কোনোদিন আর সে চাইবে না শ্লীলতাহানির বিচার । পাঁচ দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ধিকি ধিকি টিকে থাকা নুসরাতের জীবনের দীপ বুধবার রাত সাড়ে ৯টার চিরতরে নিভে যায়। সম্ভ্রমহানির বিচার চাওয়ায় আগুনে পুড়ানো মাদ্রাসাছাত্রীর নিথর দেহ ঘিরে এখন চলছে স্বজনদের আহাজারি আর কোটি মানুষের প্রার্থণা।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, লাইফ সাপোর্টে রাখা নুসরাতের অবস্থা বুধবার সকাল থেকেই তার অবস্থা অবনতি হতে থাকে। একাধিকবার তার হার্ট অ্যাটাক করেছিল, তারপরও সে সার্ভাইভ করেছিল। কিন্তু রাত সাড়ে ৯টায় তাঁকে বাচানোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
তিনি জানান, নুসরাত জাহানকে উচ্চ চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানো নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই অনুযায়ী সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়েছিল। কিন্তুু কিন্তু এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর যাওয়ার মতো নুসরাতের শারীরিক অবস্থা না থাকায় সেখানকার চিকিৎসকরা ঢাকা মেডিকেলেই নুসরাতকে চিকিৎসার দেওয়ার পরামর্শ দেন। অবস্থার একটু উন্নতি হলে সিঙ্গাপুর আনতে বলেন। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী ঢাকাতেই নুসরাতের চিকিৎসায় সর্বাত্মক সেবা দেন বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা। কিন্তু সবাইকে কাঁদিয়ে তিনি চলে গেলেন চিরতরে।
মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত সোনাগাজী পৌরসভার উত্তর চরছান্দিয়া গ্রামের মাওলানা একেএম মানিকের মেয়ে। তিনি এবার সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা থেকে আলিম (এইচএসসি সমমান) পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজউদ্দৌলা গত ২৭ মার্চ নুসরাত জাহানের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে নুসরাতের বরাত দিয়ে পরিবারকে জা গত ২৭ মার্চ দুপুরে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা তাঁর পিয়ন নুরুল আমিনকে দিয়ে নুসরাতকে অধ্যক্ষের রুমে ডেকে নেন। নুসরাত তখন আরো তিন-চারজন বান্ধবীকে নিয়ে অধ্যক্ষের রুমে ঢুকতে চাইলে শুধু তাঁকে ঢুকতে দেন পিয়ন। এরপর দরজা আটকে অধ্যক্ষ বিভিন্ন প্রলোভন দেখান। ১ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে তাঁকে প্রশ্ন দেওয়া হবে, যদি তিনি অধ্যক্ষের কুপ্রস্তাবে রাজি হন। এরপর অধ্যক্ষ নুসরাতের গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর নুসরাত দৌড়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে বাইরে গিয়ে অচেতন হয়ে পড়ে যান।
পরে নুসরাত বিষয়টি বাসায় জানালে তাঁদের মা শিরিন আক্তার সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে। ওই মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা বর্তমানে ফেনী কারাগারে আছেন। এরপর মামলা প্রত্যাহারের জন্য নুসরাতকে চাপ দেয় অধ্যক্ষের লোকজন। কিন্তু নুসরাত ও তার পরিবার এতে অপারগতা জানায়।
এ অবস্থায় আলিম পরীক্ষা শুরু হলে প্রথম দিন থেকেই নুসরাতকে তার ভাই নোমান পরীক্ষার হলে বসিয়ে দিয়ে আসতেন। ৬ এপ্রিলও তিনি তাই করেন। কিন্তু পরীক্ষার হলে নুসরাত পরীক্ষার হলে ঢোকার পর অধ্যক্ষের পক্ষের কয়েকজন ছাত্রী নুসরাতকে ডেকে ছাদে নিয়ে যায় এবং মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দেয়। নুসরাত এতে সায় না দেওয়ায় আগেই বোরখা পড়ে ছাদের অবস্থান করা কয়েকজন ব্যক্তি তার গায়ে কেরোসিন ছুড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। গায়ে আগুন নিয়েই নুসরাত চিৎকার করতে করতে দৌড়ে নিচে নেমে আসে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ছুটে গিয়ে তার গায়ের আগুন নেভান। কিন্তু নেভানোর আগেই নুসরাতের শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। তাঁকে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠান।
গণমাধ্যমে বর্বরোচিত ঘটনাটি প্রকাশ পাওয়ার পর দেশজুড়ে ঘটনাটি আলোড়ন তৈরি করে। দেশের মানুষ নুসরাতের উন্নত চিকিৎসা আর বিকৃত মানসিকতার ওই মাদ্রাসা শিক্ষকের দৃষ্টান্তমূলক সাজার দাবি জানায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।দগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তার সর্বশেষ স্বাস্থ্যের অবস্থা জানিয়ে কাগজপত্র পাঠানো হয়। মঙ্গলবার সকালে সেখানকার চিকিৎসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন ডা. সামন্তলাল সেন। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা নুসরাতের অবস্থা পর্যালোচনা করে জানান, মুমুর্ষ অবস্থায় এয়ার এম্বুলেন্সে পাঁচ ঘণ্টা ফ্লাই করা নুসরাতে খুবই ঝুকিপূর্ণ। তাই এই মুহূর্তে মেয়েটিকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া সম্ভব না। ঢাকা মেডিকেলেই নুসরাতকে চিকিৎসার দেওয়ার পরামর্শ দেন। অবস্থার একটু উন্নতি হলে সিঙ্গাপুর আনতে বলেন। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী ঢাকাতেই নুসরাতের চিকিৎসায় সর্বাত্মক সেবা দেন বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা। কিন্তু সবাইকে কাঁদিয়ে নুসরাত জাহান রাফি চলে গেলেন চিরতরে।