আগামী ৩০ মে ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসে বসতে যাচ্ছে ক্রিকেটের অন্যতম বড় আসর আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপের দ্বাদশ আসর। দ্যা ওভালে ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচের মধ্য দিয়ে পর্দা উঠবে ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় আসরটির। ১৪ জুলাই লর্ডসে ফাইনালের মধ্য দিয়ে পর্দা নামবে বিশ্বকাপের।
১৯৭৫ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে খেলাটিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে বিশ্ব ক্রিকেটের নির্বাহী সংস্থাটি। প্রতি চার বছর পর পর এক থেকে দেড় মাসব্যাপী ভক্ত সমর্থকরা মেতে থাকে ক্রিকেট উৎসবে।
শ্রীলঙ্কা এবং তৎকালীন ‘ইস্ট আফ্রিকা’সহ মোট আটটি দেশ নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্বকাপ। ১৯৭৫-২০১৫ পর্যন্ত বিশ্বকাপের ১১টি আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং অংশ নিয়েছে মোট ২০টি দেশ। তবে শিরোপা জিততে পেরেছে মাত্র পাঁচটি দেশ।
একটি আসরের প্রথম ম্যাচ মানে খেলোয়াড় ও ভক্তদের চার বছরে অপেক্ষার পালা শেষ হওয়া। মেগা এ ইভেন্টে প্রথম বল করে এগার আসরে এগার বোলার নাম লিখেছেন ইতিহাসের পাতায়। আসুন জেনে নেই এ সৌভাগ্যবান এগার বোলার কারা।
১৯৭৫ বিশ্বকাপ- মদন লাল, ভারত :
ক্রিকেট বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথম বলটি করেছেন ভারতের মদন লাল। ফর্মেটের কারণে বিশ্বকাপের প্রথম আসর ছিল বিশেষ কিছু। ইংল্যান্ডের মাটিতে ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মত অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ৬০ ওভারের। উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হয় শক্তিশালী দুই দল স্বাগতিক ইংল্যান্ড ও ভারত। ইংল্যান্ডের ওপেনিং ব্যাটসম্যান ডেনিস লিলির প্রতি বল ছুঁড়ে বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথম বল করার নাম লেখান মদন লাল। ম্যাচটি ভারত ২০২ রানের বিশাল ব্যবধানে হারলেও বিশ্বকাপ ইতিহাসে বল করা প্রথম বোলারের ইতিহাস গড়েন মদন।
১৯৭৯ বিশ্বকাপ- স্যার এ্যান্ডি রবার্টস, ওয়েস্ট ইন্ডিজ :
১৯৭৯ বিশ্বকাপে প্রথম বলটি করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের এ্যান্ডি রবার্টস। উনিশ শতকে বিশ্ব ক্রিকেটের পরাশক্তি ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গতি ও বাউন্সের কারণে পুরো বিশ্বেই আতংক সৃস্টি করেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলাররা। অন্য কোন দলের বোলিং আক্রমণই তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি। ক্যারিবিয় এই বোলিং আক্রমণের মূল কারিগর ছিলেন স্যার এ্যান্ডি রবার্টস।
উনবিংশ শতাব্দীতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের দুই মূল স্তম্ভ ছিলেন স্যার রবার্টস এবং ম্যালকম মার্শাল। এমনকি সে সময়ের সেরা ব্যাটসম্যানরাও তাদের ঠিকমত খেলতে পারতেন না।
১৯৭৯ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ মুখোমুখি হলে আসরের প্রথম বলটি করেন এ্যান্ডি রবার্টস। পুরো ইনিংসে ৯ দশমিক ১ ওভার বোলিং করে ৩২ রানে ২ উইকেট শিকার করেছিলেন রবার্টস।
১৯৮৩ বিশ্বকাপ-স্যার রিচার্ড হ্যাডলি, নিউজিল্যান্ড :
১৯৮৩ বিশ্বকাপে প্রথম বলটি করেছিলেন নিউজিল্যান্ডের রিচার্ড হ্যাডলি। ভারতীয় ক্রিকেটের ঘুড়ে দাঁড়ানোর গল্প শুরু হয় ১৯৮৩ বিশ্বকাপের মাধ্যমে। প্রথমবারের মত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ভারতীয় ক্রিকেটের দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে য্য়া। শিরোপা জয়ের পর বিশ্ব ক্রিকেটে বড় দেশে পরণিত হয় ভারত।
ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে ৯ জুন মাঠে গড়ায় ১৯৮৩ বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ড টস জিতে আগে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিলে হ্যাডলি আসরের প্রথম বল করার সুযোগ পান।
ম্যাচে নিউজিল্যান্ড দলের বোলিং আক্রমনের নেতৃত্ব দেয়া হ্যাডলি নির্ধারিত ১২ ওভারের কোটা পূরণ করেন। চারটি মেডেনসহ এ ম্যাচে মাত্র ২৬ রান দেন তিনি।
১৯৮৭ বিশ্বকাপ-বিনোথেন জন, শ্রীলঙ্কা :
ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) আয়োজিত চতুর্থ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৭ সালে। ভারত ও পাকিস্তান যৌথভাবে আয়োজন করে এ আসর। প্রথম তিনটি আসরই ইংল্যান্ডের মাটিতে হওয়ার পর প্রথমবারের মত এশিয়ার কোনো দেশ বিশ্বকাপ আয়োজনের গৌরব অর্জন করে।
হায়দারাবাদে ৮ অক্টোবর ১৯৮৭ আসরের উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান। টস জিতে পাকিস্তান আগে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিলে আসরের প্রথম বল করতে আসেন জন।
রমিজ রাজা ও ইজাজ আহমেদ জুটির বিরুদ্ধে প্রথম বল করেন জন। পুরো ইনিংসে নির্ধারিত ১০ ওভার বোলিং করে ৩১ রান খরচে উইকেট শূন্য ছিলেন জন। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে মোট ৩৪ উইকেট শিকার করেন তিনি।
১৯৯২ বিশ্বকাপ-ম্যাকডারমট, অস্ট্রেলিয়া :
আগেরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে ১৯৯২ আসর বিশ্বকাপ ইতিহাসে বড় একটা পরিবর্তন এনেছিল। এ আসরেই ফ্লাডলাইটের অধীনে সাদা বলে রঙ্গীন জার্সিতে বিশ্বকাপ শুরু হয়। এর আগের আসরগুলো ছিল ভিন্ন ধর্মী যা বড় একটা ইভেন্ট হিসেবে দর্শকদের খুব বেশি আকৃষ্ট করতে পারেনি।
যৌথ আয়োজক হিসেবে টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচ খেলার সুযোগ দেয়া হয় স্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে। এ বিশ্বকাপে প্রথম বল করার জন্য ম্যাকডারমটকে নির্বাচন করা হয়।
ওপেনিং জুটিতে খেলতে নামা জন রাইট ও আর টি লাথামকে বল করেন ম্যাকডারমট এবং বোলিং মনস্তাত্বিক এক স্পেলে দলকে জয় এনে দেন তিনি। নির্ধারিত ১০ ওভার বোলিং করে ৪৩ রানে ২ উইকেট শিকার করে ম্যাচের চিত্র পাল্টে দেন তিনি।
১৯৯৬ বিশ্বকাপ-ডোমিনিক কর্ক, ইংল্যান্ড :
১৯৯৬ বিশ্বকাপের প্রথম বলটি করেন ইংল্যান্ডের ডোমিনিক কর্ক
১৯৯২ আসরে প্রবর্তন হওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মত ১৯৯৬ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় রঙ্গীন পোষাকে। ভারতে অনুষ্ঠিত এ আসরের প্রথম ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় আহমেদাবাদের সরদার প্যাটেল স্টেডিয়ামে ১৯৯৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টস জিতে ইংল্যান্ড আগে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিলে আসরে প্রথম বল করে ইতিহাসে না লেখানোর সুযোগ পান কর্ক। নিউজিলান্ডের দুই ওপেনার সি স্পেয়ারম্যান- নাথান এ্যাস্টলকে বল করেন তিনি।
অত্যন্ত ধারাবাহিকতা বজায়ে রেখে ১০ ওভার বোলিং করে মাত্র ৩৬ রান খরচ করেন তিনি।প্রতি ওভারে ইনিংসের দ্বিতীয় সেরা ৩ দশমিক ৬ ইকোনোমি রেটে ১ উইকেট শিকার করেন কর্ক।
৭ ১৯৯৯ বিশ্বকাপ, ড্যারেন গফ, ইংল্যান্ড :
১৯৭৫-১৯৮৩ এক নাগারে তিন বারের পর চতুর্থবার ১৯৯৯ বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পায় ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপের এ সপ্তম আসরে ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে শিরোপা জিতে অস্ট্রেলিয়া। প্রথমবার ১৯৮৭’র পর দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপ শিরোপা জয় করে অসিরা।
১৯৯৯ সালের ১৪ শুরু হওয়া আসরের প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হয় শ্রীলংকা ও ইংল্যান্ড। আগে ব্যাটিং করতে নামা শ্রীলংকান দুই ওপেনার সনত জয়সুরিয়া-রোশন মহানামা জুটির বিপক্ষ প্রথম বলটি করেন ড্যারেন গফ। উদ্বোধনী ম্যাচে খুব ভাল কিছু করতে পারেননি ইংল্যান্ড বোলঅর। ৮ দশমিক ৪ ওভার বোলিং করে ৫০ রানের বিনিময়ে মাত্র ১ উইকেট নিতে সক্ষম হন তিনি।
২০০৩ বিশ্বকাপ-শন পোলক, দক্ষিণ আফ্রিকা :
নিখুত বোলিংয়ের জন্য ক্রিকেট ইতিহাসে সেরা ওপেনিং বোলার হিসেবে পরিচিত শন পোলক। ক্রিকেট ইতিহাসে পরিবর্তক হিসেবেও পরিচিত তিনি। নিজের স্যুয়িং দিয়ে পুরো বিশ্বকে শাসনের মাধ্যমে ফাস্ট বোলিং ধারায় ধরনের পরিবর্তন আনেন তিনি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত ২০০৩ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে দুই শক্তিশালী দল স্বাগতিক ক্যারিবিয় ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার ম্যাচে প্রথম বলটি করেন পোলক। মাত্র ৩ রানে জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ম্যাচে ১০ ওভার বোলিং করে ৫২ রান খরচে ২ উইকেট পেয়েছিলেন পোলক।
২০০৭ বিশ্বকাপ-উমর গুল, পাকিস্তান
পাকিস্তানের হয়ে ফাস্ট বোলার হিসেবে উমর গুলের ছিল অসাধারণ একটি ক্যারিয়ার। ক্রিকেট মেগা ইভেন্টের সপ্তম আসরটি বসেছিল ২০০৭ সালে। এ্ই প্রথমবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপ আয়োজন করে। ১৩ মার্চ দুই শক্তিশালী দল স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং পাকিস্তান বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলে। আয়ারল্যান্ড ও জিম্বাবুয়েসহ দল দু’টি লীগ পর্বে ছিল ‘ডি’ গ্রুপে।
টস জিতে আগে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়ে অধিনায়ক ইনজামাম উল হক প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যান ক্রিস গেইলের বিপক্ষে প্রথম ওভার করতে উমর গুলের হাতে বল তুলে দেন। সে ইনিংসে পাকিস্তান দলের সবচেয়ে মিতব্যয়ী বোলার ছিলেন গুল। দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তান সে আসরে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠতে পারেনি। বিস্ময়করভাবে আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে গ্রুপ পর্বেই টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিতে হয়।
২০১১ বিশ্বকাপ-শফিউল ইসলাম, বাংলাদেশ :
নিজ মাঠে ২০১১ বিশ্বকাপের প্রথম বলটি করেছিলেন বাংলাদেশের শফিউল ইসলাম। দীর্ঘ ২৮ বছর পর শিরোপা পুনরুদ্ধার করায় ২০১১ বিশ্বকাপ ছিল ভারতীয় ক্রিকেট দলের জন্য স্বপ্ন পূরনের আসর। দলগত নৈপুন্যে এ আসরের শিরোপা জয় করে টিম ইন্ডিয়া। যৌথ আয়োজক হিসেবে ঢাকার শেরে-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আসরের প্রথম ম্যাচে ভারতের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের শফিউল ইসলাম ভারতীয় ওপেনার বীরেন্দার শেবাগকে আসরের প্রথম বলটি করেছিলেন। বাউন্ডারি মেরে ইনিংস শুরু করেন শেবাগ। ম্যাচে নির্ধারিত ১০ ওভারের পরিবর্তে শফিউল শেষ পর্যন্ত ৭ ওভার বোলিং করে ৬৯ রানে শিকার করেন ১ উইকেট। বিশ্বকাপে এটা ছিল বিরাট কোহলির প্রথম ম্যাচ। শেবাগ ও কোহলি দু’জনেই ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন।
২০১৫ বিশ্বকাপ-নুয়ান কুলাসেকারা, শ্রীলঙ্কা :
২০১৫ এগারতম বিশ্বকাপের প্রথম বলটি করেছিলেন শ্রীলঙ্কান পেসার নুয়ান কুলাসেকারা।
আইসিসি আয়োজিত সর্বশেষ বিশ্বকাপটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৫ সালে, যৌথভাবে আয়োজক ছিল অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। ফাইনালে সহ আয়োজক নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। এটা ছিল অস্ট্রেলিয়ার পঞ্চম বিশ্বকাপ শিরোপা জয়।
তবে ২০১৫ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছির নিউজিল্যান্ড-শ্রীলঙ্কা। নিউজিল্যান্ড প্রথমে ব্যাটিং নিলে শ্রীলঙ্কা অধিনায়ক বোলিং ওপেনিং করতে বল তুলে দেন নুয়ান কুলাসেকারার হাতে।
জয়ের জন্য শ্রীলঙ্কাকে ৩২২ রানের টার্গেট দেয় নিউজিল্যান্ড। কিন্তু লঙ্কানরা ২৩৩ রানে গুটিয়ে গেলে ৯৮ রানে জয় পায় নিউজিল্যান্ড। তবে ২০১৫ বিশ্বকাপে প্রথম বল করে ইতিহাসের অংশ হয়ে যান কুলাসেকারা।