কামরুন্নাহার মল্লিকা এবং মেহেদী হাসান দম্পত্তির মামলার শুনানি কালে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন যে - ‘বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রত্যেক ডিভোর্সে ’সবার অনুভূতি, কষ্ট একই রকম।
আদালত বলেন, ‘ধ্রুব ও লুব্ধক আসলে সমাজের হাজারো শিশুর অব্যক্ত অনুভূতি তুলে ধরেছে। এটা সমাজের জন্য একটা ম্যাসেজ। অন্যরা বলার সুযোগ পায় না। আর তার বাবা-মায়েরা সন্তানের সেই অনুভূতি বোঝে না।’শুনানির শুরুতেই আদালত আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘পরিস্থিতির কী কোনো উন্নতি হয়েছে?’
আইনজীবী তাপস কান্তি বল বলেন, ‘হ্যাঁ,কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মা ছুটি নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে ঘুরেছেন। বাবাও বাচ্চাদের সময় দিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে একটি সমস্যাও দেখা দিয়েছে। ছোট বাচ্চাটির তার বাবাকে রাতে থেকে যাওয়ার আবদার জানালে বাবা রাজি হলেও মা রাজি হননি। রাত ১টায় বৃষ্টির মধ্যে বাবাকে বের হয়ে যেতে হয়েছে।’
আইনজীবী তাপস বলেন, ‘বাবা সারেন্ডার করেছে বাচ্চারা যেভাবে চাইবে বাবা তাই করবেন।’
আদালত বলেন, ‘এটাকে কী পরিস্থিতির উন্নতি মনে করেন?’
তাপস বলেন, ‘কিছু তো উন্নতি হয়েছে।’
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘এটা পুরোপুরি পারিবারিক ইস্যু। সুতরাং দুজনের মধ্যেই সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য আরো সময় লাগবে।’
আদালত বলেন, ‘তা ঠিক। এটা তো রাতারাতি উন্নতি হবে না।’
ব্যারিস্টার কাজল বলেন, ‘বাচ্চা দুটি ইতিমধ্যে ঢাকায় স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বাচ্চারা খুশি। প্রতিদিন মা স্কুলে আনা নেওয়া করছেন।’
আদালত বলেন, ‘ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাচ্চাদের অভিপ্রায় উপেক্ষা করে স্কুলে ভর্তি করলে হয় না।’
কাজল বলেন, ‘এই ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর যেখানে গিয়েছি সেখানে বলেছে তোমরা পূণ্যের কাজ করেছ। আদালতের প্রতি মানুষের উচ্চ আকাঙ্ক্ষা বেড়ে গেছে। কোর্ট সমঝোতার জন্য সময় দিয়েছেন। এটা সর্বমহলে বার্তা দিয়েছে। শিশুদের কল্যাণ বিবেচনায় পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে। তবে উভয়পক্ষকে মনে রাখতে হবে,আদালতের নমনীয়তায় যদি তারা অন্যকিছু ভেবে থাকেন তাহলে সেটা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে আদালতের হাত খাটো না। বাচ্চাদের মঙ্গল চিন্তা করে আদালত যেকোনো আদেশ দিতে পারেন।’
আইনজীবী তাপস বলেন, ‘বাচ্চারা যদি চায় বাবাকে যেন বাসায় থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। প্রয়োজনে ড্রয়িংরুমে থাকবে।’
আদালত বলেন, ‘অপেক্ষা করুন, সমঝোতা হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আদালত শিশু ও বাবা দুজনের কথা শোনেন। বাবা ও মাকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, ‘আপনারা দুজনই শিক্ষিত সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন মানুষের কাছে কী বার্তা গেছে? আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই।’
আইনজীবী তাপস বলেন, ‘মা ছুটি নিয়ে ঘুরছেন। বাবারও ইচ্ছা ঘুরতে।’ আদালত বলেন, ‘বাবাও ঘুরতে পারবেন।’ পরে আদালত পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ১ আগস্ট দিন নির্ধারণ করেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ওই দুই শিশুর মা কামরুন্নাহার মল্লিকা রাজশাহীর মেয়ে। পড়তেন ঢাকা গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে। বাবা মিয়া মো. মেহেদী হাসান, মাগুরার ছেলে। পড়ালেখা করেছেন ঢাকা কলেজে। পড়ালেখা অবস্থায় দুজনের পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেম। এরপর ২০০২ সালে বিয়ে হয় তাঁদের। শুরু হয় দাম্পত্য জীবন। দুজনের ঘর আলোকিত করে আসে দুটি ফুটফুটে সন্তান। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয় দুই ছেলেকে। পড়ালেখা শেষ করে মেহেদী একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন,মল্লিকা একটি বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা। ভালোই চলছিল সংসার। একপর্যায়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য ঘটে। এ মনোমালিন্য শেষ হয় বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে। ২০১৭ সালের ১২ মে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। স্বামী মেহেদী হাসান স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার এক সপ্তাহ আগে দুটি সন্তানকে গ্রামের বাড়ি মাগুরায় পাঠিয়ে দেন। বোনের তত্ত্বাবধানে মাগুরার জেলা শহরের একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়।
মেহেদী হাসান ঢাকার উত্তরায় থাকলেও দুই ছেলের সুখের জন্য তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি সন্তানদের ব্যবহারের জন্য দিয়ে দেন। মাগুরায় বড় হচ্ছিল শিশু দুটি। এই এক বছর মা-সন্তানদের মধ্যে কোনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি।
মা কামরুন নাহার মল্লিকার অভিযোগ, সব রকম চেষ্টা করেও সন্তানের ফুপুর কারণে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত সন্তানদের নিজের হেফাজতে নেওয়ার জন্য হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। এজন্য নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করলে গত ২৯ মে আদালত শিশু দুটিকে হাইকোর্টে হাজির করতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও শিশু দুটির বাবাকে নির্দেশ দেন। ২৫ জুন তাদের হাজির করতে বলা হয়। একই সঙ্গে সন্তানকে কেন মায়ের হেফাজতে দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। ৪ জুলাই পর্যন্ত শিশু সন্তান দুটি মায়ের হেফাজতে থাকবে। তবে এই সময়ে বাবা শিশু দুটির দেখাশোনা করার অবারিত সুযোগ পাবেন। ৪ জুলাই পরবর্তী দিন ঠিক করে সেদিন শিশু দুটিকে হাজির করার নির্দেশ দিয়ে বিষয়টি মুলতবি করেন। একইসঙ্গে শিশুদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় দেওয়ার জন্য বাবা-মাকে নির্দেশ দেন। আজ ৪ জুলাই পরিবারটি বাচ্চা নিয়ে হাজির হওয়ার পর আদালত সময় দিয়ে ১ আগস্ট আদেশের জন্য পুনর্নির্ধারণ করেন।