আবার এসেছিল বৈশাখ, পাড়া-প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে দেখেছি আনন্দের বন্যা। আর আমাদের ছোট্টঘর নিকোষ অন্ধকারে আচ্ছন্ন। অথচ গত বছরের এই সময় আমাদের এ সংসারে কতইনা আনন্দ ছিল। আজ আপুমণিকে হারিয়ে সব উৎসব অশ্রুজলে বিবর্ণ হয়ে গেছে। ঘাতকের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল আমাদের সোনালি সংসার।
কখনও ভাবিনি আমাদের সমাজে মানুষের পোশাকধারী কিছু অসভ্য জন্তু-জানোয়ার বসবাস করে। যদি আগে জানতে পারতাম তা হলে কলিজার টুকরো আপুকে কখনও ঘর থেকে বের হতে দিতাম না। মানুষ কতটা নির্দয়-নির্মম হলে একজন মানুষকে পুড়িয়ে মারতে পারে! কি অপরাধ ছিল আমার আপুর?
একজন লম্পটের যৌন নিপীড়ন রুখে দিতে প্রতিবাদী হয়েছিল আমার আপু। সেই প্রতিবাদে মৃত্যু হয়েছে ১০৮ ঘন্টা বার্ন ইউনিটে আপুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বাবা-মায়ের পর শিক্ষকরাই আমাদের বড় অভিভাবক। আর সেই অভিভাবক যখন একজন ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন, তখন মনে হয় এই সমাজ আর ভালো নেই।
আবার লম্পটকে বাঁচানোর জন্য তার পক্ষে নিয়েছিল কিছু রাজনীতিবিদ ও মানুষরূপী লম্পট। লম্পটের বিচার চাইতে গিয়েছিলাম ওসি সাহেবের কাছে। তিনি আমার আপুকে নিরাপত্তা না দিয়ে মানসিক নির্যাতন করে ভিডিও করলেন। ওসি সাহেব যদি সচেতন হয়ে বিষয়টি তদন্ত করতেন, কিংবা আমার আপুর নিরাপত্তা জোরদার করতেন, তা হলে আমার আপুকে পরপারে পাড়ি জমাতে হতো না।
মনে পড়ছে আপুমণির আইসিইউতে বলা শেষ কথাগুলো- 'রায়হান, আম্মা-আব্বার দিকে খেয়াল রাখিস। আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে বারণ করিস। আমাকে যারা পুড়িয়ে দিল, তাদের যেন সঠিক বিচার হয়। না হলে আমি মরেও শান্তি পাব না।' প্রধানমন্ত্রী আমার আপুর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। লম্পটদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আপুকে দেশের বাহিরে পাঠানোর জন্য ডাক্তারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ডাক্তাররা সর্বোচ্চ করেও আপুকে বাঁচাতে পারেনি। আমাদের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী ডেকে তিনি একজন মমতাময়ী মায়ের পরিচয় দিয়েছেন। আমরা তার কাছে বলেছি- আমার আপুর হত্যাকারীদের যেন দ্রুত বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হয়। তিনি আমাদের নিশ্চিত করেছেন, বিচারে কোনো দুর্বলতা রাখা হবে না।
আসামিদের রেহাই দেয়া হবে না বলে তিনি জানিয়েছেন। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিচার-প্রশাসনের প্রতি আস্থা রেখে বলতে চাই- এই সকল জানোয়ারদের কঠিন শাস্তি দেয়া প্রয়োজন।
ভবিষ্যতে যেন কোনো ভাইয়ের বুক থেকে তার বোনকে কেড়ে নিতে না পারে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরে দেখি আপুর রুমটা খালি পড়ে আছে, যেই টেবিলে বসে পড়ালেখা করত সেখানে বইখাতাগুলো ঠিকই আছে। আছে আপুর ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলো।
নেই শুধু আমার কলিজার টুকরো আপুটি। বিশ্বাস করুণ- একবুক চাপা কষ্ট, বেদনায় আমার ছোট্ট হৃদয়টি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। প্রতিটি মুহূর্তে মনে পড়ে যায় আপুর কথা। ঘুমের ঘোরে জেগে উঠি আপুর শেষ দিনগুলোর নির্মম কষ্টের কথা স্বপ্নে দেখে। শেষ রাতে চোখে একফোঁটা ঘুম আসে না আপুর কথা ভেবে।
আমাদের পরিবারের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক ছিল আপু। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে তার ছিল আন্তরিকতাপূর্ণ ভালোবাসার সম্পর্ক। শান্ত মেজাজের অধিকারী হওয়ায় পরিবারের সব সমস্যা অত্যন্ত ধীরচিত্তে সমাধান করত। আমাদের সঙ্গে তো দূরের কথা পাড়া-প্রতিবেশীর কারও সঙ্গে কোনো দিন ঝগড়া-বিবাদে নিজেকে জড়ায়নি।
আব্বুর অনেক আস্থাভাজন হওয়ার কারণে, আব্বু কোনো দিন তার প্রিয় সন্তানের কোনো চাহিদা অপূর্ণ রাখেননি। প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর তার কোরআন তিলাওয়াতের মধুর সুর এখনও আমার কানে বাজে।
বাড়ির সব কাজে আম্মুকে সহযোগিতা করত। আম্মু আমাদের নিয়ে টেনশন করলে, আপু অভয় দিয়ে বলত- আমরা এমন কোনো কাজ করব না যাতে আপনাদের সম্মান হানি হয়। বরং আমরা তিন ভাইবোন পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে সমাজে আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করব। সেই উজ্জ্বলতার প্রতিচ্ছবি ছিল আমাদের সংসার।
আপুর মতো ক্ষণজন্মা বোন আমাদের ছোট ঘরকে সবসময় আলোকিত করে রাখত, যা আজ নিভে গিয়ে একমুঠো ছায়ায় পরিণত হয়েছে। আজ সারা দেশে, এমনকি দেশের বাহিরেও আমার আপুর হত্যাকাণ্ডে মানুষ যেভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে, তাতে আমার মনে পড়ে যাচ্ছে কবির বলে যাওয়া কথা-
'এমন জীবন করিবে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন' আল্লাহর কাছে একটিই চাওয়া- আমার আপুকে যেন তিনি জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন। আর খুনিদের দুনিয়া ও আখেরাতে কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। (আমিন)
এই লেখাগুলো বোনের অতীত স্মৃতিকে স্মরণ করে নিজের ডায়েরিতে লিখেছেন অগ্নিদ্বগ্ধে নিহত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান। সে ওই মাদ্রাসারই দশম শ্রেণির ছাত্র। বোনের ওপর যৌন নিপীড়নের খবর পেয়ে নিজেকে স্থির রাখতে পারেনি এই রায়হান।
প্রথম ঘটনার দিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ লাঠি নিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজকে বারবার মারতে চেয়েও স্থানীয়দের বাধার মুখে মারতে পারেনি। কারও বোনের ওপর হায়েনার আঁচড় পড়লে কেইবা স্থির থাকতে পারে?