চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাবেক সভাপতি-অভিনেতা আহমেদ শরীফ ও তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ৩৫ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বৃহস্পতিবার তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ওই অনুদানের চেক গ্রহণ করেন।
এরপর বিভিন্ন মহল থেকে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। অনেকেই জানতে চেয়েছেন, বরেণ্য এই অভিনেতা কোন রোগে ভুগছেন? অনেকের অভিযোগ, এই অভিনেতা একটা সময় বিএনপির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী। এ নিয়ে ফেসবুকেও চলছে বিতর্ক।
ঘটনা সত্যতা জানতে সোমবার যোগাযোগ করা হয় এই অভিনেতার সঙ্গে। জানতে চাওয়া হয়, তার অসুখের কথা।
উত্তরে আহমেদ শরীফ বলেন, ‘বার্ধক্যজনিত কারণে আমি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। ঠিক মতো হাঁটাচলা করতে পারি না। ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, প্রস্টেটের অসুবিধাসহ নানা অসুখে ভুগছি। কিছুদিন আগে, পিত্তথলিতে পাথর ধরা পড়ার কারণে অস্ত্রোপচারও করেছি। আমি ঠিকমতো হাটতে পারি না। অনেক আগে শুটিং করতে গিয়ে, পড়ে পা ভেঙে গিয়েছিল। সেসময় অস্ত্রোপচার করে পায়ে রড বসানো হয়েছে। ১৮ বছর ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছি।’
আহমেদ শরীফ বলেন, ‘আমার বয়স এখন ৭৪ বছর। এই বয়সে একজন মানুষ কতটুকুই সুস্থ থাকে। শরীরও এখন আগের মতো সাড়া দেয় না। দিনের বেশির ভাগ সময় ঘরে শুয়ে-বসে কাটাতে হয়। চিকিৎসার অভাবে আমার স্ত্রীর চোখটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওর চোখের রেটিনায় সমস্যা। আমার একটি মেয়ে আফিয়া মোবাসসিরা মৌরি। পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিনগুলো কাটছে আমার।’
কথা উঠেছে, গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর থেকে অনুদানের চেক নিয়ে ওই দিন রাতেই চলচ্চিত্র প্রযোজক শফি বিক্রমপুরীর ৫০তম বিয়েবার্ষিকীর আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দেন আহমেদ শরীফ। ওই অনুষ্ঠানে তিনি মেতে ছিলেন আনন্দ-আড্ডায়, এ নিয়েও ফেসবুকে চলছে তুমুল সমালোচনা।
এ প্রসঙ্গে আহমেদ শরীফ বলেন, ‘চলচ্চিত্র প্রযোজক শফি বিক্রমপুরীর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। তার অনেক ছবিতে আমি অভিনয় করেছি। তাদের বিয়েবার্ষিকী অনুষ্ঠানে গিয়েছি, এটা সত্য। কিন্তু আনন্দ-আড্ডায় তো আর মাতিনি। উপস্থিত অতিথিরা নিশ্চয়ই দেখেছেন, আমি সেখানেও অসুস্থবোধ করছিলাম। তাই দেরি না করে বাসায় চলে এসেছি।’
হাউজিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকা প্রসঙ্গে এই অভিনেতা বলেন, ‘এসব কথা শুধুই মিথ্যাচার। অভিনয়ের বাইরে আমি আর কোনো পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলাম না, এখনো নেই। যারা বলছে, আমি হাউজিং ব্যবসা করি, তাদের উদ্দেশে বলব, তারা প্রমাণ করুক। অভিনয়কেই একমাত্র পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম, এর বাইরে আর কিছুই না। আমি ৪৮টি বছর দেশের মানুষের জন্য কাজ করেছি, তাদের বিনোদন দিয়েছি।’
আপনি তো উত্তরায় থাকেন, ওটা কি আপনার নিজের বাড়ি? উত্তরে আহমেদ শরীফ বলেন, ‘না, আমার নিজেস্ব কোনো বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট নেই। আমি উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টেরের একটি বাড়িতে থাকি। ওখানে আমি প্রায় ২০ বছর ধরে ভাড়া থাকছি। চাইলে আপনারা এসে খোঁজ নিতে পারেন। আমার বাড়িওয়ালা আছে কিংবা আশপাশের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন।’
অনেকেই বলছেন, আপনি বিএনপির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছাত্রদলের নেতাও ছিলেন? ২০০৩ সালে খুলনা সরকারি মহিলা কলেজের একটি অনুষ্ঠানে ইতিহাস বিকৃত ও বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়েছিলেন?
এসব প্রশ্নের উত্তরে আহমেদ শরীফ বলেন, ‘এসব কথা আমার কানেও এসেছে। যে সময়টার কথা বলা হচ্ছে, ২০০৩ সাল। ওই সময় আমি অসুস্থ হয়ে দীর্ঘ দেড় বছর বিছানায় পড়েছিলাম। তখনই হায়দ্রাবাদে শুটিং করতে গিয়ে আমার পা ভেঙেছিল। ওই সময় আমি টোটালি বিছানায়। আমার কাছে দলিল-প্রমাণ আছে। চাইলে আপনারা এসে দেখতে পারেন।’
এই অভিনেতা আরও বলেন, ‘আমি কখনও বিএনপির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। রমনা- রেসকোর্স ময়দানে, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের দিন আমিও উপস্থিত ছিলাম। তখন ছাত্রবস্থায় বন্ধুদের সঙ্গে বসে আমিও সেই ভাষণ শুনেছি। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে, আমরা নিশ্চিত ছিলাম এবার আমরা স্বাধীন হবো। বঙ্গবন্ধু ছাড়া এই দেশ কোনোভাবেই স্বাধীন হতো না। তার নেতৃত্ব না থাকলে, দেশের মানুষ স্বাধীনতা পেতো না। আমি কিংবা আমার পরিবারের কেউই বিএনপির রাজনীতি করেনি।’
নিজের পরিবার সম্পর্কে আহমেদ শরীফ বলেন, ‘আমার পরিবার সম্পর্কে একটু বলতে চাই, আমার দাদা প্রয়াত মৌলভী সামছুদ্দিন আহমেদ অবিভক্ত বাংলার একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সময় পরপর তিনবার মন্ত্রী ছিলেন উনি। আমি তার নাতি। আমার দাদারা ছয় ভাই। সবাই সে সময়ের নামিদামি মানুষ ছিলেন। আমাদের পরিবার হচ্ছে কুষ্টিয়ার আহমেদ পরিবার। সবাই আমাদের এক নামে চেনেন। আমি আপনাদের এইটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমি ও আমার পরিবার লোকজন না খেয়ে থাকব, তবুও মিথ্যাচার করব না। দয়া করে আমাকে নিয়ে কেউ মিথ্যাচার করবেন না।’
সবশেষে বরেণ্য এই অভিনেতা বলেন, ‘আমি এই সরকারের আমলেই হজ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেই ২০১৬ সালে আমি হজে যাই। সে কথা আমি মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি। তিনিও আমার সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন। জেনে-শুনেই তিনি আমাকে ও আমার পরিবারকে সাহয্য করেছেন। একজন দুস্থ ও অসুস্থ শিল্পীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এজন্য তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। দোয়া করি, তিনি দীর্ঘজীবী হোন।’
উল্লেখ্য, অভিনেতা আহমেদ শরীফ প্রায় আট শতাধিক বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত প্রথম ছবির ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। সুভাষ দত্ত পরিচালিত এই ছবিতে তিনি অভিনয় করেন নায়ক চরিত্রে। খলনায়ক হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর পরিচালনায় ‘বন্দুক’ ছবিতে, যা মুক্তি পায় ১৯৭৬ সালে। তার অভিনীত সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত ‘দুলাভাই জিন্দাবাদ’। ছবিটি মুক্তি পায় ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর। আর মুক্তি অপেক্ষায় আছে শামীম আহমেদ রনি পরিচালিত ‘শাহেনশাহ’ ছবিটি।