ফ্রিদা কাহলো মেক্সিকান চিত্রশিল্পী। মারা যাওয়ার ৬৪ বছর পরও তিনি জনপ্রিয়। শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর চুল, পোশাক নিয়ে এখনো ডিজাইনাররা, রূপবিশেষজ্ঞরা কাজ করে চলেছেন। ভক্তরাও সেই ধারা গ্রহণ করছেন। ফ্রিদার স্টাইল, ফ্যাশন এখনো জীবন্ত। তিনি হয়ে উঠেছেন ফ্যাশন আইকন।
তিনি কখনোই স্বপ্ন আঁকতেন না। বরং নিজের বাস্তবতা তুলে ধরতেন রং-তুলিতে। শিল্পী ও ব্যক্তি দুই জায়গাতেই তিনি ছিলেন শক্তিশালী। ফ্রিদা কাহলোর পুরো জীবনই যেন নাটকের কাহিনি। আর এ কারণেই বোধ হয় তিনি অর্জন করেছিলেন ভিন্নতা। সামাজিক বাধা-নিষেধ উপেক্ষা করে উদ্যাপন করে গেছেন জীবনকে। পুরো নাম মাগদালেনা কারমেন ফ্রিদা কাহলো ই ক্যালদেরোন। বিয়ে করেছিলেন বিশ্বখ্যাত মেক্সিকান চিত্রশিল্পী দিয়েগো রিভেরাকে (১৮৮৬–১৯৫৭)। পেশায় চিত্রশিল্পী। তাঁর সময়ে সেরা তিন ফ্রেসকো শিল্পীর একজন। মেক্সিকোতে ম্যুরাল আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন দিয়েগো রিভেরা।
ফ্রিদার জন্ম ১৯০৭ সালের ৬ জুলাই, মেক্সিকোর কোয়োকান শহরে। মৃত্যু ১৯৫৪ সালের ১৩ জুলাই। জন্ম-মৃত্যু একই মাসে। এ মাসেই ফ্রিদার ১১১তম জন্মবার্ষিকী এবং ৬৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।
ফ্রিদা কাহলো ফ্যাশন আইকনে পরিণত হয়েছেন। এর কারণ হলো ফ্রিদা তাঁর সাজ–পোশাকে স্বকীয় ধারা তৈরি করেছিলেন। নারীর কোমলতা তুলে ধরতে চাননি, বরং নারী শক্তিকেই প্রকাশ করেছেন। নিজের মধ্যে থাকা পুরুষালী বৈশিষ্ট্যও তিনি লুকাতে চাননি, বরং তা দৃঢ়তার সঙ্গেই প্রকাশ করেছেন। উজ্জ্বল রঙের ফুল, বিচিত্র গয়না আর পোশাকের নকশায় তিনি তাঁর জীবনকেই যেন উদ্যাপন করেছেন। এ জন্য তিনি পরিণত হয়েছেন ফ্যাশন আইকনে।
তাঁর আঁকা ছবিও অনন্য বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে। মেক্সিকোর সেই সময়ে কোনো নারীই তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বাইরে আনতেন না। ফ্রিদা কাহলো তাঁর ছবিতে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনকে তুলে ধরতেন। যা দেখে অনেকেই প্রথমে একটা ধাক্কা খেত। পরে অবশ্য তাঁর সময়ে সবচেয়ে আলোচিত নারী চিত্রশিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পান ফ্রিদা।
ফ্রিদার আঁকা ছবি এবং তাঁর ফ্যাশনকে বুঝতে হলে জানতে হবে তাঁর ব্যক্তিজীবন। ৪৭ বছরের বেশির ভাগ অংশই জুড়ে ছিল কষ্ট আর বেদনা। ছয় বছর বয়স থেকে। পোলিওতে আক্রান্ত হন। ১৮ বছর বয়সে বাস ও ট্রলির ভয়াবহ দুর্ঘটনায় শারীরিকভাবে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন। ভাগ্যের পরিহাস—রোগী হয়েই রইলেন পুরো জীবন।
ওই দুর্ঘটনার পর বেশ কয়েক মাস শয্যাশায়ী ছিলেন। মা মাটিলদে কালডেরোনি গনজালেজ বানালেন বিশেষ ইজেল। ফ্রিদা বিছানায় শুয়েই ছবি আঁকা শুরু করলেন। বাবা গুলিরমো কাহলো তাঁর রঙের বাক্স ও তুলি ধার দিলেন মেয়েকে। পড়াশোনা বাদ দিলেন, ফ্রিদার সব মনোযোগ চলে গেল ছবি আঁকার দিকে। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়ার কাহিনি।
ফ্রিদা ও দিয়েগো দম্পতি—বিয়ের পরেও দুজন একাধিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন। বিচ্ছেদ হয়েছে, আবার ফিরে এসেছেন। বিয়ে করেছেন। একসঙ্গে থেকেছেন। দরজা খোলাটাই যেন বাকি ছিল। ৫০ বছরের ব্যবধান নিমিষেই হাওয়া । তারপর তো বিস্ময়ের শুরু। ফ্যাশনপ্রেমীরা মুগ্ধ হয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন তাঁর পোশাক, সাজের সরঞ্জাম, লেস বসানো জুতা, রোদচশমা ইত্যাদি। ডিজাইনাররা তাঁর পোশাক থেকে পেলেন অনুপ্রেরণা, নিলেন তাঁর ধ্যান–ধারনা, তাঁর নানা বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন ফটোশুটে, ফ্যাশন শোর র্যাম্পে তাঁর চুলের সাজ এখনো পাচ্ছে জনপ্রিয়তা।
ফ্রিদা কাহলোর আঁকা ১৪৩টি ছবির ৫৫টিতে দেখা যায় তাঁর আত্ম–প্রতিকৃতি। ১৯৫৪ সালে মারা যাওয়ার এত বছর পরও মেক্সিকান চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কাহলো যেন নতুনভাবে তৈরি করে চলেছেন অগণিত ভক্ত। বিশেষ ভূমিকা রাখছে তাঁর পোশাক ও চুলের সাজ। মেক্সিকোর সীমানা পেরিয়ে ফ্রিদার নতুন ঠিকানা এখন ভিনদেশের আনাচকানাচের ফ্যাশনপ্রেমী ভক্তদের হৃদয়ে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত বছর পর আবার কেন ফ্রিদা? ফ্রিদা মারা যাওয়ার পর তাঁর স্বামী মেক্সিকান চিত্রশিল্পী দিয়েগো রিভেরার নির্দেশেই ফ্রিদার সবকিছু তালাবদ্ধ করে রাখা হয় বাড়ির বাথরুমের এক কোনায়। শর্ত ছিল দিয়েগো মারা যাওয়ার ১৫ বছর পর তালা খোলা যাবে। ২০০২ সালে সালমা হায়েক অভিনয় করেন ফ্রিদার জীবন নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্র ফ্রিদায়। এই ছবিও একটা কারণ, ফ্রিদার আবার আলোচনায় ফিরে আসার। ফ্রিদায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করে সালমা হায়েক অস্কারে সেরা অভিনেত্রীর মনোনয়ন পেয়েছিলেন। মোট ছয়টি মনোনয়ন পাওয়া ফ্রিদা ছবিটি সংগীত ও মেকআপে অস্কার জিতেছিল।
দিয়েগো রিভেরা মারা যান ১৯৫৭ সালে। তাঁর মৃত্যুর ১৫ বছর পর নয়, প্রায় ৪৭ বছর পর ২০০৪ সালে খোলা হয় সেই নীল বাড়ির দরজা। এ বাড়িটি ফ্রিদার বাবা-মায়ের। পরে অবশ্য এ বাড়িতেই ফ্রিদা ও তাঁর স্বামী থাকতেন।
০১২ সালে মেক্সিকোর সেই নীল বাড়িকে জাদুঘর বানিয়ে ফ্রিদার আঁকা ছবি, পোশাক, গয়না, অনুষঙ্গ, ব্যবহার্য নানা নিদর্শন তুলে ধরা হয়। চলতি বছর পোশাক-আশাক, অনুষঙ্গসহ ফ্রিদার ব্যবহৃত ২০০ নিদর্শন মেক্সিকোর বাইরে দেখানো হচ্ছে। এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে লন্ডনের দ্য ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়াম। ‘ফ্রিদা কাহলো: মেকিং হার সেল্ফ আপ’ শিরোনামের এই প্রদর্শনী এখন চলছে। চলবে আগামী ৪ নভেম্বর পর্যন্ত।