দীর্ঘ ত্যাগ-তিতিক্ষার পরও দলে কিংবা সরকারে মূল্যায়িত হননি এমন নেতাদের ভাগ্য খুলছে আওয়ামী লীগে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত এমপি ও বর্তমান মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রীরাও থাকছেন এ তালিকায়।
এছাড়া যোগ্যতার মাপকাঠিতে এগিয়ে থেকেও তৃণমূলের যেসব নেতা দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত মেনে দলীয় পদ-পদবি ও এমপিত্ব বিসর্জন দিয়েছেন তারাও মূল্যায়িত হবেন স্থানীয়ভাবে। আসন্ন ঈদুল ফিতরের পর এবং আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের আগে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে আওয়ামী লীগ।
দলটির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এ প্রতিবেদককে বলেন, যারা দলে ও সরকারে স্থান পাননি তাদের বিভিন্নভাবে মূল্যায়িত করা হবে। সরকারের অনেকগুলো অনুবিভাগ আছে। সেগুলোতে অনেককে নিয়োগ দেয়া হতে পারে। এছাড়া মন্ত্রণালয়েও নিয়োগ পেতে পারেন অনেকে। আবার অনেককে দলীয় কোনো বড় পদ দেয়া হতে পারে। সেটা আগামী জাতীয় সম্মেলনের আগেই হওয়ার সম্ভাবনা।
আওয়ামী লীগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা যাতে দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় হয়ে না পড়েন সেজন্য বিভিন্নভাবে তাদের মূল্যায়ন করার চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে এ সিদ্ধান্তের কথা সংশ্লিষ্ট নেতাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তালিকা প্রণয়নে শুরু হয়েছে নিবিড় পর্যবেক্ষণ। কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত বঞ্চিত নেতাদের দলীয় কর্মসূচিতে থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এসব নেতাদের সরকারের বিভিন্ন অনুবিভাগ- ব্যাংক, বীমা, কর্পোরেশন, বিভিন্ন কমিশনে নিয়োগ দেয়ার চিন্তা চলছে। সরকারের খালি থাকা এক ডজন মন্ত্রণালয়েও স্থান পাবেন কেউ কেউ।
এছাড়া জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বঞ্চিত নেতাদের সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তের চেষ্টা চলছে। আবার বঞ্চিত কিছু নেতাকে দলের গুরুত্বপূর্ণ বড় পদ দেয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে এমপি-মন্ত্রীর মতো দলীয় মর্যাদা পেতে পারেন তারা।
এদিকে আওয়ামী লীগের আরেকটি সূত্র জানায়, মাঠপর্যায়ে আওয়ামী লীগকে আরও সুদৃঢ় করতে মনোনয়নবঞ্চিতদের নিয়ে কাজ করছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রেখে এখন থেকেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির টার্গেট রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৪৫ এমপি দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন। তারা সবাই এখন সাবেক এমপি। এদের মধ্যে ৫ জন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। তারা হলেন- আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর নানক ও আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও বিএম মোজাম্মেল হক এবং কার্যনির্বাহী সদস্য ও সাবেক দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া।
৪৭ সদস্যের মন্ত্রিসভার ৩১ জনই নতুন। বাদ পড়েছেন পুরনো মন্ত্রিসভার ৩৬ জন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, পরিবেশমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক।
সংরক্ষিত মহিলা আসনে পুরনো ৪২ জনের ৪০ জনই বাদ পড়েছেন। যে ৪৩ জন সংরক্ষিত আসনে এমপি হয়েছেন তাদের ৪১ জনই নতুন।
এছাড়া পঞ্চমপর্বের উপজেলা নির্বাচনের প্রথম চার ধাপে অনেক পুরনো চেয়ারম্যান দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে নির্বাচন করতে পারেননি। তারাও এ বঞ্চিতের তালিকায়। স্থানীয়ভাবে তাদেরও মূল্যায়নের চিন্তা করছে আওয়ামী লীগ। এর বাইরে সারা দেশে প্রায় এক হাজারের মতো জনপ্রিয় নেতা রয়েছেন যারা জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থিতা করার মতো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন। স্থানীয়ভাবে ভাগ্য খোলার তালিকায় তাদের নামও রয়েছে।
১৯ মে স্বল্প পরিসরে মন্ত্রিসভা পুনর্বিন্যাস করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে কাউকে সংযুক্ত কিংবা বাদ দেয়া হয়নি। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মো. মুরাদ হাসানকে তথ্য প্রতিমন্ত্রী পদে স্থানান্তর করা হয়েছে। এছাড়া ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার বিভাগ পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, অক্টোবরে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের আগে দলে ও সরকারে সমন্বয় করতে মন্ত্রিসভায় বড় পরিবর্তন আসতে পারে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রিপরিষদে এখনও ৯টি মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রী নেই। সেগুলো হচ্ছে- প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, নৌ পরিবহন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, পানিসম্পদ, সংস্কৃতি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের কাছে যে চারটি মন্ত্রণালয় রেখেছেন, তার মধ্যে কমপক্ষে তিনটি- জনপ্রশাসন; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়েও কেউ কেউ মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাতীয় নির্বাচনে এমপি পদে দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত ৪৫ এমপি, মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া ৩৬ জন সাবেক মন্ত্রী, সংরক্ষিত আসনে পুনরায় মনোনয়নবঞ্চিত ৪২ জন নারী এমপি পুরোদমে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়নবঞ্চিতরাও এখন তৃণমূলে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার ক্ষোভ আর হতাশা থেকে যাতে বঞ্চিতরা নিষ্ক্রিয় না হয়ে পড়েন সেজন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি গণভবনে ডেকে অনেককে সান্ত্বনা দিয়েছেন। বিভিন্নভাবে আশ্বস্ত করেছেন।
জাতীয় নির্বাচনে বঞ্চিত কেন্দ্রীয় চার নেতাকে গণভবনে ডেকে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন। দায়িত্ব পেয়ে তারা দক্ষতার সঙ্গে তৃণমূলের সঙ্গে নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন। বিদ্রোহ দমন করেছেন। নির্বাচনী বিশৃঙ্খলা এড়াতে চিহ্নিতদের ঢাকায় ডেকে শাসন করেছেন। বিশৃঙ্খল ছাত্রলীগকে শৃঙ্খল করতেও কাজ করেছেন তারা।
বরিশাল-২ আসনে মনোনয়নবঞ্চিত সাবেক এমপি তালুকদার মো. ইউনুস বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদককে বলেন, এখন এলাকায় বেশি সময় দিচ্ছি। রোজার মধ্যে ইফতারসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে কর্মসূচি করেছি। কেন্দ্র থেকেও নির্দেশনা দেয়া আছে। মূল্যায়নের কথা শুনেছি।
একই কথা বলেছেন পটুয়াখালী-৩ আসনের সাবেক এমপি আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে কর্মসূচিতে কম অংশগ্রহণ করছেন তিনি।
এদিকে সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া সাবেক ৩৬ মন্ত্রী। এদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী তৃণমূলে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ৮টি সাংগঠনিক টিমে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে তারা বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কর্মী সম্মেলন, বর্ধিত সভা করছেন।