ক্যাচ জেতায় ম্যাচ। ক্রিকেট সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানা লোকেরা এই লাইনের সঙ্গে পরিচিত বেশ ভালো করেই। একটি ক্যাচ যেমন ম্যাচ জিতিয়ে দিতে যথেষ্ট হয় অনেক সময়, তেমনি একটি ক্যাচ মিসের আক্ষেপ কুঁকড়ে খায় অনন্তকাল। গত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের টান টান উত্তেজনাকর ম্যাচে ৪৮তম ওভারে ক্রিস ওকসের ক্যাচ ছেড়ে তামিম যে ভুলটি করেছিলেন, সেটি শেষ পর্যন্ত খুব বড় হয়ে দেখা দেয়নি রুবেলের অতিমানবীয় বোলিংয়ে।
সে তুলনায় লঙ্কান অলরাউন্ডার থিসারা পেরেরার ভাগ্য খুব একটা প্রশস্ত নয়। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল ১৬২ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে যখন ধুঁকছিল পাকিস্তান, ঠিক তখনই মালিঙ্গার বলে ক্যাচ তুলে দেন পাকিস্তান অধিনায়ক সরফরাজ, আর পেরেরা সেই ক্যাচ হাতের তালুতে জমাতে পারেননি। ফলাফল শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ফাইনালে পাকিস্তান।
ক্যাচের মূল্য ক্রিকেট মাঠে বেশ চড়া। তাই তো একটি ভালো ক্যাচকে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিতে মোটেও কার্পণ্য করেন না কেউ। বিশ্বকাপ ইতিহাসেও এমন অসংখ্য ক্যাচ দর্শকদের আবেগকে নাড়া দিয়েছে, দলকে পৌঁছে দিয়েছে জয়ের প্রান্তে। তেমন কিছু ক্যাচের কথাই জানাব আপনাদের।
জন্টি রোডসের বাঁ হাতের খেল! ছবি: ইউটিউব
জন্টি রোডস (দক্ষিণ আফ্রিকা)
সর্বকালের সেরা ফিল্ডারের তালিকা নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু সেই তালিকার একদম শুরুর দিকে যে জন্টি রোডস থাকবেন তা প্রশ্নাতীত। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে এই কিংবদন্তির একটি ক্যাচ ক্রিকেটপ্রেমীদের স্মৃতিতে থাকবে অনেক দিন। ইংল্যান্ডের রবার্ট ক্রফটের ভয়ংকর জোরে মারা একটি শট শূন্যে লাফিয়ে এক হাতে তালুবন্দী করেন পয়েন্টে দাঁড়ানো রোডস।
ডোয়াইন লেভেরক (বারমুডা)
ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে অনুষ্ঠিত ২০০৭ বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল বারমুডা। ওই একবারই ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চে আসার সুযোগ পেয়েছিল তারা। মনে রাখার মতো কোনো ফল অবশ্য পায়নি তারা। তবু একটি কারণে বারমুডার নাম মনে থাকবে অনেকের, আর সেটি হচ্ছে স্থূলকায় এক ক্রিকেটারের এক অতিমানবীয় ক্যাচ। ভারতের বিপক্ষে বারমুডার গ্রুপ পর্বের ম্যাচে দ্বিতীয় ওভারেই ওপেনার রবিন উথাপ্পার বল এজ হয়ে যায় স্লিপে। নিজের বিশাল বপুকে হার মানিয়ে ডান দিকে ঝাঁপিয়ে এক হাতে ক্যাচটি লুফে নেন ডোয়াইন লেভেরক। বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্যাচ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে এটি।
অজয় জাদেজা (ভারত)
১৯৯২ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারতের ম্যাচ। ৪৯তম ওভারে কপিল দেবের বলে অ্যালান বোর্ডার যখন বলটি উড়িয়ে মারেন, অজয় জাদেজা তখন লং অফে দাঁড়িয়ে। অজয় জাদেজা লং অফ থেকে অনেকটা জায়গা দৌড়ে এসে সামনে ডাইভ দিয়ে দুর্দান্ত এক ক্যাচ তালুবন্দী করেন।
মার্ক ওয়াহ (অস্ট্রেলিয়া)
পাকিস্তানকে ফাইনালে অনেকটা হেসেখেলে হারিয়ে ১৯৯৯ বিশ্বকাপ জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। ফাইনালে ওয়াজাহাতুল্লাহ ওয়াস্তির ব্যাটের কানায় লেগে বল পৌঁছে গিয়েছিল স্লিপে। দ্বিতীয় স্লিপে দাঁড়ানো মার্ক ওয়াহ নিজের ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক হাতে বলটি তালুবন্দী করেন। এই অবিশ্বাস্য ক্যাচ দিয়েই শুরু হয় ম্যাচে পাকিস্তানের পতন।
দারুণ এক ক্যাচ লুফে নেওয়ার পর দলের অন্যদের সঙ্গে কপিল দেবের উল্লাস। ফাইল ছবি
কপিল দেব (ভারত)
১৯৮৩-তে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় শিরোপাটি নিজেদের করে নেয় ভারত। ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান ভিভ রিচার্ডসকে ফেরাতে দারুণ একটি ক্যাচ নিয়েছিলেন কপিল দেব নিজেই। মিড উইকেট থেকে পুরোটা সময় উল্টো দৌড়ে প্রায় বাউন্ডারির কাছাকাছি গিয়ে ক্যাচটি মুঠোবন্দী করেন। সে ক্যাচেই ম্যাচের গল্প বদলে গেছে।
ভাসবার্ট ড্রেক্স (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
নামটা খুব পরিচিত মনে না–ও হতে পারে। ২০০৩ বিশ্বকাপে কানাডার বিপক্ষে পাঁচ উইকেট পেয়েছিলেন এই পেসার। তবে মানুষ তাঁকে মনে রাখবে জন ডেভিসনের ক্যাচের জন্য। ৬৭ বলে সেঞ্চুরি করা ডেভিসন অবিশ্বাস্য খেলছিলেন সেদিন। ইনিংসের সপ্তম ছক্কা হাঁকাতে গিয়েছিলেন ২৩তম ওভারে। বাউন্ডারির একদম সামনে শূন্যে লাফিয়ে উঠে হাতের মুঠোয় নিয়েছিলেন ড্রেক্স। ক্যাচটি এতটাই অবিশ্বাস্যভাবে তালুবন্দী করেছিলেন যে কয়েক মুহূর্তের জন্য ধারাভাষ্যকারেরাও ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন। সে ধাক্কা সামলাতে না পেরে ৪২ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে অলআউট কানাডা!
ডেল স্টেইন (দক্ষিণ আফ্রিকা)
ক্রিকেটে পেস বোলারদের দুর্নাম আছে। ফিল্ডিংয়ে নাকি খুব একটা আলো ছড়াতে পারেন না তাঁরা। যাঁরা এমনটা মনে করেন, তাঁরা ইউটিউবে গিয়ে দেখে নিতে পারেন পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০১৫ বিশ্বকাপে ডেল স্টেইনের ক্যাচটি। কাইল অ্যাবটের বলে আহমেদ শেহজাদের শূন্যে ভাসিয়ে দেওয়া বলটাকে অবিশ্বাস্য দক্ষতায় হাতে জমিয়েছিলেন স্টেইন।
ভারতের বিপক্ষে লেভেরকের সেই অবিশ্বাস্য ক্যাচ! ছবি: এএফপি
শেন থমসন (নিউজিল্যান্ড)
শেন থমসন নিউজিল্যান্ডের হয়ে ৫৬টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। ক্যারিয়ার খুব একটা বর্ণাঢ্য নয় যদিও, তবু ১৯৯৬ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে স্কয়ার লেগে তাঁর নেওয়া ক্যাচটি বিশ্বকাপের সর্বকালের সেরা ক্যাচগুলোর অন্যতম। পেছনের দিকে উল্টো হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নেওয়া থমসনের ক্যাচটি না দেখে থাকলে নিশ্চিতভাবেই মিস করছেন বিশেষ কিছু!
ড্যানিয়েল ভেট্টোরি (নিউজিল্যান্ড)
২০১৫ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড দলের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য ছিলেন ড্যানিয়েল ভেট্টোরি। ৩৬ বছর বয়সী ভেট্টোরি তবু প্রমাণ করেছেন, তখনো মিইয়ে যাননি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যান মারলন সামুয়েলস থার্ড ম্যান দিয়ে হাওয়ায় ভাসানো এক শটে বাউন্ডারি মেরেছেন বলে ধরেই রেখেছিলেন। তখনই দেখলেন বুড়ো ভেট্টোরি শূন্যে লাফিয়ে বাঁ হাত দিয়ে ছোঁ মেরে বলটাকে নামিয়ে আনলেন হাতের মুঠোয়। মাঠের দর্শকেরা যেন নিজেদের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সেদিন!
বেন স্টোকস (ইংল্যান্ড)
এবারের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই আন্দিলে ফিকোয়াওকে ফেরাতে বেন স্টোকসের অতিমানবীয় ক্যাচটির কথা উল্লেখ না করলে তালিকাটি অপূর্ণই থেকে যাবে। দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংসের ৩৫তম ওভারের প্রথম বলে ফিকোয়াও স্লগ সুইপ করে বল পাঠিয়ে দেন ডিপ মিড উইকেটে, শূন্যে ভাসতে থাকা বলটিকে এক হাতে ছোঁ মেরে তালুবন্দী করেন বেন স্টোকস। সাবেক ইংলিশ স্পিনার ফিল টাফনেল তো বিবিসিতে এসে দাবিও করে ফেললেন, এটিই নাকি ‘শতাব্দীর সেরা ক্যাচ’!
মাত্র তো দুদিন গেল বিশ্বকাপের। পাকিস্তানের সুবাদে দেড় দিন! সামনের ম্যাচগুলোতে এমন আরও অবিশ্বাস্য, অতিমানবীয় সব ক্যাচ দেখার অপেক্ষায় গোটা বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীরা।