ওভালে বাংলাদেশের মহাকাব্যিক জয়। শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টাইগারদের রেকর্ডগড়া জয়। ইংল্যান্ড ও ওয়েলস বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ২১ রানে জিতলো মাশরাফিবাহিনী।
সৌম্য-তামিমের বিধ্বংসী শুরু; সাকিব-মুশফিকের রেকর্ড গড়া জুটি আর শেষে মাহমুদউল্লাহ-মোসাদ্দেকের ব্যাটে চড়ে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে রান পাহাড় গড়ে বাংলাদেশ। এটাই এখন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের গত বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩২২ রান ছিল এতদিনের সর্বোচ্চ। ২০১৫ সালে নেলসনে স্কটিশরা করেছিল ৩১৮ রান, এই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে জয় নিশ্চিত করা বাংলাদেশ করেছিল ৩২২। আজ ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে নিজের প্রথম ম্যাচেই সেটা টপকে গিয়ে ৩৩০ রান নিয়ে নতুন রেকর্ড গড়লো বাংলাদেশ। রেকর্ডগড়া এই রান তাড়া করতে গিয়ে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৮ উইকেটে ৩০৯ রানেই থামলো প্রোটিয়ারা। এতে টানা দুই ম্যাচেই হারলো ফাফের দল।
রোববার লন্ডনের দ্য ওভাল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে তিনটায় শুরু হয় ম্যাচটি। বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ হলেও এটি দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় ম্যাচ। নিজেদের প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে ১০৪ রানের বিশাল ব্যবধানে হেরেছে প্রোটিয়ারা। টসে জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছে ফাফ।
ব্যাটিংয়ে নেমে সতর্ক শুরু করে বাংলাদেশ। দারুণ শুরুর পর ইনিংসের নবম ওভারে বিদায় নেন তামিম। দলীয় ৬০ রানের মাথায় প্রথম উইকেট হারায় বাংলাদেশ। আন্দ্রেইল ফেলুকাওয়োর বলে খোঁচা দিতে গিয়ে উইকেটের পেছনে কুইন্টন ডি ককের গ্লাভসবন্দি হন তামিম। তার আগে ২৯ বলে দুটি চারের সাহায্যে করেন ১৬ রান।
তামিম বিদায় নিলেও সাকিবের সাথে জুটি বেধে মারমুখী ছিলেন সৌম্য সরকার। কিন্তু দলীয় ৭৫ রানে মরিসের বাউন্সারে পুল করতে গিয়ে তালুবন্দী হন ডি ককের। ফলে ৩০ বলে ৯ চারের সাহায্যে ৪২ রান তুলেন সৌম্য।
ক্রিস মরিসকে চার মেরে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৪৩তম হাফসেঞ্চুরির দেখা পান সাকিব। সেই সঙ্গে ক্রিকেটের তিন ফরম্যাট মিলে ১১ হাজার রানের দেখা পেয়েছেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাঠে নামার আগে এই মাইলফলক থেকে ছয় রান দূরে ছিলেন সাকিব।
সাকিবের পর হাফসেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন মুশফিক। আন্দিলে ফেলুকায়োকে চার মেরে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৩৪তম হাফসেঞ্চুরি করেছেন তিনি। তামিম-সৌম্যের বিদায়ের পর খানিকক্ষণ চাপে পড়লেও অভিজ্ঞ সাকিব আল হাসান আর মুশফিকুর রহিমের ব্যাটে দ্রুতই সেই বাজে অবস্থা কেটে যায়। দুজনের জুটিতে আসে ১৪২ রান। সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিমের ব্যাটে বিশ্বকাপে নিজেদের সেরা জুটি পেয়েছে বাংলাদেশ। গত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পঞ্চম উইকেটে মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে মুশফিকের ১৪১ রানের জুটি ছিল আগের সেরা।
ইনিংসের ৩৬তম ওভারের প্রথম বলে বিদায় নেন সাকিব। ইমরান তাহিরের বলে বোল্ড হওয়ার আগে সাকিব করেন ৭৫ রান। সাকিব তার ৮৪ বলের ইনিংসে ৮টি চারের পাশাপাশি একটি ছক্কা হাঁকান। দলীয় ২১৭ রানের মাথায় বিদায় নেন সাকিব। এরপর ব্যাটিংয়ে নেমে বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রান টানছিলেন মোহাম্মদ মিঠুন। ইনিংসের ৪০তম ওভারে ইমরান তাহিরের বলে বোল্ড হন তিনি। তার আগে ২১ বলে দুই চার আর একটি ছক্কায় ২১ রান করেন মিঠুন। দলীয় ২৪২ রানের মাথায় বাংলাদেশ চতুর্থ উইকেট হারায়। পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হন রানমেশিন মুশফিকুর রহিম। ফেলুকাওয়োর বলে ডিপ পয়েন্টে ডুসেনের হাতে ধরা পড়ার আগে মুশফিক করেন ৭৮ রান। মিডলঅর্ডারের এই ব্যাটিং স্তম্ভ ৮০ বলে আটটি চার হাঁকান।
এরপর মোসাদ্দেককে সঙ্গে নিয়ে এগুতে থাকেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ইনিংসের ৪৯তম ওভারে বিদায় নেন মোসাদ্দেক। ফেলুকাওয়োর বলে ক্রিস মরিসের হাতে ধরা পড়ার আগে তিনি করেন ২০ বলে ২৬ রান। যেখানে ছিল চারটি চারের মার। ৩৩ বলে ৪৬ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলে অপরাজিত থাকেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ৩ বলে ৫ রান করে অপরাজিত থাকেন মেহেদি হাসান মিরাজ। ফেলুকাওয়ো, ক্রিস মরিস আর ইমরান তাহির দুটি করে উইকেট তুলে নেন।
৩৩১ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই সাবধানী ছিলেন দুই ওপেনার মার্কারাম ও ডি কক। ১০ম ওভারে মেহেদি হাসান মিরাজের বল ঠিকমতো খেলতে পারেননি ওপেনার ডি কক। ক্যাচ উঠলেও মুশফিক বল গ্লাভসবন্দি করতে পারেননি। আইডেন মার্কারামের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ডি কক। বল কুড়িয়ে স্ট্যাম্প ভেঙে দেন মুশফিক। বিদায়ের আগে ডি কক ৩২ বলে চারটি চারের সাহায্যে করেন ২৩ রান। দলীয় ৪৯ রানে প্রথম উইকেট হারায় প্রোটিয়ারা।
এরপর ৫৩ রানের জুটি গড়েন দলপতি ফাফ ডু প্লেসিস এবং ওপেনার আইডেন মার্কারাম। ইনিংসের ২০তম ওভারে সাকিব বোল্ড করেন মার্কারামকে। দলীয় ১০২ রানের মাথায় প্রোটিয়ারা দ্বিতীয় উইকেট হারায়। বিদায়ের আগে মার্কারাম ৫৬ বলে চারটি চারের সাহায্যে করেন ৪৫ রান।
দুই ওপেনার ফিরে গেলেও মাশরাফিদের গলার কাঁটা হয়ে ক্রিজে ছিলেন প্রোটিয়া অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসি। ইনিংসের ২৭তম ওভারে মিরাজের ঘূর্ণিতে বোল্ড হন ডু প্লেসি। ৫৩ বলে ১ ছক্কা ও ৫ চারের সাহায্যে ৬২ রান তুলেন ডু প্লেসি।
ইনিংসের ৩০তম ওভারে সাকিবের বলে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডেভিড মিলার। সৌম্য সরকার লাফিয়ে ক্যাচটি লুফে নিতে পারেননি। ব্যক্তিগত ১৮ রানে জীবন পান কিলার মিলার। ব্যক্তিগত ৩২ রানের মাথায় মোস্তাফিজের বলে আবারো ক্যাচ তুলে দেন মিলার। থার্ডম্যানে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ক্যাচটি নিতে পারেননি। ৩৬তম ওভারে মোস্তাফিজের বলে মিরাজের তালুবন্দি হয়ে ফেরেন ডেভিড মিলার। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে মিরাজের হাতে ধরা পড়ার আগে তিনি ৪৩ বলে দুই বাউন্ডারিতে করেন ৩৮ রান।
মোস্তাফিজুর রহমানের ভেতরে ঢোকা বল ব্যাটে খেলতে পারেননি বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। রাসি ফন ডার ডাসেনের সঙ্গে কথা বলে রিভিউ নেন দুমিনি। বল ট্র্যাকিংয়ে দেখা যায় স্টাম্পের উপর দিয়ে যেতো বল। পাল্টায় আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত, বেঁচে যান দুমিনি।
এরপর আক্রমণে ফিরলেন সাইফুদ্দিন। দ্রুত এগোনোর চেষ্টায় থাকা রাসি ফন ডার ডাসেনকে বোল্ড করে ফিরিয়ে দিলেন মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন। ডানহাতি পেসারের স্টাম্পের বলে ক্রস ব্যাটে খেলতে চেয়েছিলেন ফন ডার ডাসেন। ব্যাটে-বলে করতে পারেননি, এলোমেলো হয়ে যায় স্টাম্পস। ৩৮ বলে দুই চার ও এক ছক্কায় ৪১ রান করেন তিনি। এরপর নিজের ৫ম ওভারে সাইফুদ্দিনের বলে সাকিবের ক্যাচ হয়ে ফিরলেন ফেলুকায়ো। সাজঘরে ফেরার আগে তার সংগ্রহে ৮ রান। দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ তখন ৬ উইকেটে ২৫২ রান।
ডুমিনির সাথে জুটি বেধে বাংলাদেশকে চেপে ধরছিল মরিস। কিন্তু ৪৬তম ওভারে মোস্তাফিজের বলে উড়িয়ে মারতে গিয়ে বাউন্ডারি সীমানায় সৌম্যের হাতে ধরা পড়েন মরিস(১০)।
দক্ষিণ আফ্রিকার আশা হয়ে টিকেছিলেন জেপি দুমিনি। ইনিংসের ৪৬তম ওভারে প্রোটিয়াদের শেষ ভরসাকে ফেরালেন মোস্তাফিজ। শেষের দিকে রাবাদা-তাহির মিলে দক্ষিণ আফ্রিকার হারের ব্যবধানই কমিয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে উড়ন্ত সূচনা করলো বাংলাদেশ।