জাহালম এখন রিকশাচালক। সবার দৃষ্টি এড়িয়ে রাতের অন্ধকারে যাত্রী নিয়ে ফেরেন ঘোড়াশাল পৌর এলাকার অলিগলিতে। সেই জাহালম, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় বিনা অপরাধে যিনি তিন বছর কারাভোগ করেছেন এবং দেশব্যাপী এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে ছাড়া পেয়েছেন।
বাংলাদেশ জুট মিলের এ শ্রমিকের কারামুক্তির পর চাকরিটি ফের মিললেও আজও একদণ্ড স্বস্তি মেলেনি যাপিতজীবনে। নরসিংদীর পলাশ শিল্প এলাকায় অবস্থিত বিজেএমসির আওতাধীন ওই মিল থেকে আসন্ন ঈদ উপলক্ষে মাত্র ৩০০ টাকা মজুরি পেয়েছেন ভাগ্যবিড়ম্বিত এ যুবক।
যান্ত্রিক সময়ের ফেরে উপায়হীন জাহালম অগত্যা জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন অযান্ত্রিক ত্রিচক্রযান-রিকশা। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জাহালম জানান, বিনাদোষে তিন বছর কারাভোগের কারণে শুধু শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। বলেন, আদালতের নির্দেশে বিজেএমসির চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করে এক মাস আগে মিল শ্রমিকের চাকরিটি ফিরে পেয়েছি।
এবারের ঈদে মিল কর্তৃপক্ষ ১২ সপ্তাহের মধ্যে ৭ সপ্তাহের মজুরিসহ ঈদ বোনাস দিয়েছে শ্রমিকদের। আমি মজুরি হিসেবে পেয়েছি মাত্র ৩০০ টাকা। আর কাজে উপস্থিত না থাকায় পাইনি ঈদ বোনাস। এই সামান্য পরিমাণ টাকা পেয়ে আমি দিশাহারা হয়ে পড়েছি। আমার একমাত্র সন্তান দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী চাঁদনীর (৮) জন্য ঈদে একটা নতুন জামা পর্যন্ত কিনতে পারিনি। তাই বাধ্য হয়ে রিকশা চালাচ্ছি।
লোকলজ্জার কারণে দিনের বেলায় চালাতে সংকোচ হয়। রাতে ঘোড়াশাল পৌর এলাকার অলিগলিতে রিকশা টেনে অতিকষ্টে দিন পার করছি, বলেন তিনি। এত অভাবেও সুখের সন্ধান করে ফেরেন জাহালম। বুক থেকে ওঠে আসা দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে বলেন, এত কষ্টে চলার পরও সন্তান ও পরিবার-পরিজন নিয়ে এবার ঈদ করতে পারব, এও কম সুখের নয়। গত তিনটি বছর আমার পরিবার আমাকে ছাড়া ঈদ করেছে।
এটি যে কত কষ্টের তা আমিই জানি। গত তিনটি বছর আমার স্ত্রী কল্পনা বেগম সংসার টানতে গিয়ে ঘোড়াশালের একটি কারখানায় চাকরি করেছে। তার যৎসামান্য বেতনে কোনোমতে চলত সংসার। কিন্তু আমার মামলা চালাতে গিয়ে সহায়সম্বল সবই খোয়াতে হয়েছে। আমি এখন পথের ভিখারি হয়ে গেছি। টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার ধুবুড়িয়া গ্রামের ইউসুফ আলীর ছেলে জাহালম বাংলাদেশ জুট মিলের তাঁত বিভাগের শ্রমিক।
সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা ৩৩টি মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার ভুলে আবু সালেক নামে এক ব্যক্তির পরিবর্তে তিন বছর কারাভোগ করেন জাহালম। গত জানুয়ারিতে এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ৩ ফেব্রুয়ারি সব মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে ওই দিনই জাহালমকে মুক্তির নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত।
আদেশের কয়েক ঘণ্টা পর সেদিনই কারাগার থেকে মুক্তিপান জাহালম। আইনি যুদ্ধে মুক্তি মিললেও মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে জীবনযুদ্ধ অব্যাহত আছে তার। বিনাদোষে জীবন থেকে হারিয়ে ফেলা তিনটি বছরের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেন জাহালম। জানান মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা ফিরে পেতে তার দীর্ঘকালীন চিকিৎসা প্রয়োজন।