বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা! স্ত্রী শত চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারলেন না তার সদ্য বিবাহিত স্বামীকে। প্রকাশ্যে যে দুই যুবক এই হত্যালীলা চালালেন, তারা কারা? এ প্রশ্ন এখন সমগ্র দেশবাসীর।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, হত্যাকারী দুই জনের একজন রিফাত ফরাজী আরেকজন নয়ন (২৫) বন্ড। দুজনই অনেক আগে থেকেই অপরাধ জগতের পরিচিত মুখ। তাদের কারণে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ।
রিফাত শরীফকে (২৫) কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে বরগুনা সদর থানায় এই হত্যা মামলা দায়ের করেন তিনি। মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে খুনের মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত সাব্বির হোসেন নয়নকে, যে এলাকায় ‘নয়ন বন্ড’ নামেও পরিচিত।
দুই নম্বর আসামি রিফাত ফরাজি, তিন নম্বর আসামি রিশান ফরাজি, চার নম্বর আসামি চন্দন। এর মধ্যে চন্দনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, নেয়াজ রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় চন্দন নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।
দুই খুনি নয়ন ও রিফাতের বিষয়ে স্থানীয় ও ভুক্তভোগী এলাকাবাসী জানান, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন ও ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে যুক্ত ছিলেন রিফাত ফরাজী। এ কারণে স্থানীয়দের কাছে একটি আতঙ্কের নাম রিফাত ফরাজী। রিফাতের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। প্রতিবেশী ও স্থানীয়দের ওপর হামলা, মারধর রিফাতের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এসব কারণে কয়েকবার গ্রেপ্তার হলেও অজ্ঞাত এক কারণে খুব স্বল্প সময়েই মুক্তি পান তিনি। ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় তরিকুল ইসলাম (২১) নামে এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করেন রিফাত ফরাজী।
সেই তরিকুল জানান, একদিন সামান্য কথা কাটাকাটি হয় রিফাত ফরাজীর সঙ্গে। তখন রিফাত ফরাজী তাকে কুপিয়ে জখম করার হুমকি দেন। রিফাত ফরাজীর ভয়ে তিনি দেড় মাস ওদের বাসার সামনে দিয়ে না গিয়ে আধা কিলোমিটার পথ ঘুরে তার বাসায় যাওয়া-আসা করতেন। হুমকি দেয়ার দেড় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন সন্ধ্যায় রিফাত ফরাজীর বাসার সামনে দিয়ে তরিকুল তার বাসায় যাওয়ার পথে রিফাত ফরাজী দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তার মাথায় গুরুতর জখম করেন। এ ঘটনায় তরিকুলের বাবা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।
একই বছর রিফাত বরগুনার হোমিও চিকিৎসক ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ডিকেপি রোডের বাসার ছাত্র মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে বাসায় থাকা সব ছাত্রকে জিম্মি করে তাদের ১৪টি মোবাইল ছিনতাই করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হলে পুলিশ রিফাতের বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে মোবাইলগুলো উদ্ধার করেন।
২০১৭ সালে বরগুনায় ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন ও দেশীয় অস্ত্রসহ নয়নসহ দুইজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ।
বরগুনার বেতাগী উপজেলার কাজিরাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা মারজানা মনি বলেন, ২০১৭ সালের রমজানে আমার একমাত্র ছোট ভাই হাফেজ মো. মেহেদী হাসান বরগুনার হোমিও চিকিৎসক আলাউদ্দিন ডাক্তারের বাসা সংলগ্ন মসজিদে তারাবির নামাজ পড়ায়। তখন রিফাত ফরাজী একদিন মেহেদীর কাছ থেকে স্যামস্যাং গ্যালাক্সি কোর প্রাইম মডেলের বিদেশ থেকে আনা একটি ফোন ছিনিয়ে নেয়। বিষয়টি রিফাত ফরাজীর মা-বাবাসহ স্থানীয় অনেককে জানানোর পরও আমার ভাইয়ের মোবাইলটি কেউ উদ্ধার করে দিতে পারেনি। পরে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করার পর সাড়ে সাত হাজার টাকার বিনিময়ে মোবাইলটি ফিরিয়ে দিয়ে হুমকি দেয় রিফাত ফরাজী। পরে রিফাত ফরাজীর হুমকিতে ওই এলাকা ছেড়ে একপ্রকার পালিয়ে আসে আমার ভাই।
বরগুনা সরকারি কলেজের দক্ষিণ-পশ্চিমে বরগুনা পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডে নয়ন বন্ডের (২৫) বাসা। নয়নের বাবা মৃত মো. ছিদ্দিকুর রহমান। দুই ভাইয়ের মধ্যে নয়ন ছোট। নয়নের বড় ভাই মিরাজ দীর্ঘদিন ধরে সিঙ্গাপুর প্রবাসী হওয়ার কারণে মাকে নিয়েই ওই বাসায় বসবাস করছে নয়ন। ২০১৭ সালের ৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে নয়ন বন্ডের বাসায় অভিযান চালায় বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় বিপুল পরিমাণ মাদক, দুটি দেশীয় অস্ত্র ও এক সহযোগীসহ নয়ন বন্ডকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এসব মাদকের মধ্যে ছিল ৩০০ পিস ইয়াবা, ১২ বোতল ফেনসিডিল ও ১০০ গ্রাম হেরোইন।
এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বরগুনা সদর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা করে নয়ন বন্ড ও তার সহযোগী ইমামের বিরুদ্ধে। পরে তাদের জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর সম্প্রতি জামিনে বেরিয়ে আসে নয়ন বন্ড। জেল থেকে বেরিয়েই মূলত এ হত্যাকাণ্ড ঘটায় সে।
এ বিষয়ে বরগুনা সদর থানার ওসি আবীর হোসেন মাহমুদ বলেন, নয়ন বন্ডের মাদক বাণিজ্যের কথা আমরা জানি। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র মামলাসহ একাধিক মামলার কথাও আমরা জেনেছি। এর আগে নয়ন ও তার সহযোগী জেল খেটেছে। জামিনে তারা বেরিয়ে যায়। রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয়নসহ সবাইকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনার কলেজ সড়কের ক্যালিক্স কিন্ডারগার্টেনের সামনে রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি একবার এ খুনির কাছে তো, আরেকবার ও খুনির কাছে। কখনও পেছন থেকে জাপটে ধরছেন, আবার কখনও একেবারে খুনির হাতে থাকা রাম দায়ের সামনে গিয়ে পথ আগলে ধরছেন। কিন্তু স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেলে চলে হামলা। এরই মধ্যে রক্তাক্ত হন স্বামী রিফাত। রক্তে ভিজে যায় তার শার্ট-প্যান্ট। কিন্তু এ ঘটনার সময় শত শত লোক এবং শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থল ও আশেপাশে উপস্থিত ছিল। এমন অবস্থা দেখেও রিফাতকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি কেউই। সবাই তখন ভিডিও করা নিয়ে ছিল ব্যস্ত।
একাধারে রিফাতকে কুপিয়ে বীরদর্পে অস্ত্র উঁচিয়ে এলাকা ত্যাগ করে হামলাকারীরা। তারা চেহারা লুকানোরও কোনো চেষ্টা করেনি। গুরুতর আহত রিফাতকে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বিকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বলেন, নয়ন প্রতিনিয়ত আমার পুত্রবধূকে উত্ত্যক্ত করতো এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপত্তিকর পোস্ট দিতো। এর প্রতিবাদ করায় আমার ছেলেকে নয়ন তার দলবল নিয়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, আমার একমাত্র ছেলেকে যারা দিনে-দুপুরে কুপিয়ে হত্যা করেছে, তাদের বিচার চাই।
রিফাতের ওপর হামলার ঘটনার স্থানটি বরগুনা জেলা পুলিশের সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত ছিল। কিন্তু ওই সময় পুলিশও তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। এমনকি পুলিশের সিসি ক্যামেরার আওতায় এ ঘটনা ঘটলেও ঘটনাস্থলে যায়নি পুলিশ।
তবে পুলিশ বলছে, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে রিফাতের খুনিদের শনাক্ত করা হয়েছে। এ ঘটনাটি পুলিশের সিসি ক্যামেরার আওতায় ছিল। ঘটনাস্থলে সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি পুলিশ।