সামাজিক মাধ্যম থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন, তবু কানে তো আসেই। গায়েও জ্বালা ধরায় কমবেশি। আজ মহানায়ক তো কাল ধিক্কৃত খলনায়ক- দেশীয় মনোভাবের এমন চরমপন্থার সব শেষ শিকার মাশরাফি বিন মর্তুজা।
ভারতের কাছে হারের পরই তিনি বসেছিলেন দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে। পাকিস্তান ম্যাচ নয়, নিজের অবসর পরিকল্পনাই নাকি করেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। তাঁর হাঁটুতে সাতটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাঁর অবসরের গুঞ্জন উঠেছে সম্ভবত তার চেয়েও বেশি। এবার নিজেই ভাবতে শুরু করেছেন। ৫ জুলাই লর্ডসে অনুষ্ঠেয় পাকিস্তান ম্যাচেই কি চূড়ান্তভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়াবেন মাশরাফি বিন মর্তুজা? শেষ সিদ্ধান্ত তাঁরই। তবে অধিনায়কের বিদায় ভাবনায় সিনিয়রদের নিজ নিজ অভিমতও রয়েছে।
একজন মনে করেন, জুলাইয়ের শেষভাগে শ্রীলঙ্কা সফর দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিন মাশরাফি। কিন্তু শ্রীলঙ্কার ওই সফরে যাওয়ার ব্যাপারে নাকি বিশেষ আগ্রহ নেই মাশরাফির। ক্ষয়িষ্ণু শরীরের কিছু বিশ্রাম যে প্রাপ্য।
তাই বিকল্প হিসেবে আরেকজনের ইচ্ছা ক্রিকেট বোর্ড যদি কোনো একটি দলকে দেশে এনে একটি সিরিজের ব্যবস্থা করে, তাহলে মন্দ হয় না। দেশের মাটিতে বিদায় নিতে চান সব ক্রিকেটারই, মাশরাফিও ব্যতিক্রম নন। কিন্তু ঠাসা ক্রিকেট সূচির মাঝে কোনো দলকে কি সহসা নিমন্ত্রণ করতে পারবে বিসিবি?
তাই তৃতীয় বিকল্প পাকিস্তান ম্যাচ। দেশে যদি সিরিজ আয়োজন সম্ভব না হয়, তাহলে বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে, সেটাও লর্ডসের মতো মাঠেই না হয় অবসর নিন মাশরাফি বিন মর্তুজা? যত দূর জানা গেছে, অধিনায়ক শুধু শুনেছেন। নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তের কথা এখনো সতীর্থদের জানাননি।
তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ একজনের বিশ্বাস, ‘উনি যদি বিদায় নেনই, সেটা শ্রীলঙ্কা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রথমত, দেশের মাটি থেকে বিদায় নেওয়ার ইচ্ছে তাঁর। ওই সফরে তিনি যাবেন কি না, তারই ঠিক নেই। বিদেশের মাটি থেকে বিদায় নিতে হলে লর্ডসই ভালো। তবে খুব ভালো হয় যদি বোর্ড কোনো একটা হোম সিরিজ আয়োজন করে। বড় দলগুলো ব্যস্ত। কিন্তু জিম্বাবুয়ের তো আর ব্যস্ততা নেই।’
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভীষণ ব্যস্ত! বিশ্বকাপের আগে মাশরাফির হাতে ট্রফির স্বপ্ন দেখেছিলেন যাঁরা, তিন ম্যাচ পর থেকে তাঁর অকার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা শুরু করে দেয় তাঁদের সিংহভাগই। অবস্থা এমনই যে, মনে হতে পারে মাশরাফি না খেললে কাপই জিতে ফেলত বাংলাদেশ! এ মানসিকতা উদ্বেগ ছড়িয়েছে দুর্দান্ত সফল এক সিনিয়র ক্রিকেটারের মনেও। তিনি অতীতে দেখেছেন। তাই ভালো করেই জানেন আজ যাঁরা মাথায় তুলে নাচছেন একটু এদিক-সেদিক হলেই সমালোচনার ঝোড়ো হাওয়া উড়িয়ে দেবে তাঁকেও।
তাই বাংলাদেশ দলের ভেতর থেকেই নতুন একটা ট্রেন্ড চালুর চেষ্টা চলছে, বিদায়বেলায় যেন সম্মানজনক একটা মঞ্চ পান। গত চার বছরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠা ‘মাশরাফি ভাই’কে নিয়ে জনমনে যে চর্চা হচ্ছে, সেটিকে নিজের জন্যও অশনিসংকেত মনে করছেন দলের শীর্ষ তারকাও।
এক সিনিয়র ক্রিকেটার সেদিন মনে উষ্মা নিয়ে বলছিলেন, ‘একজন মানুষ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দলকে সার্ভিস দিয়েছে। সেই তাকে আপনি গোটা কয়েক ম্যাচ দিয়ে বিচার করে ফেলবেন? এটা ঠিক যে মাশরাফি ভাই আগের ফর্মে নেই। একদিন তিনি খেলা ছেড়েও দেবেন। তাই বলে তাকে নিয়ে অসম্মানজনক কথা বলবেন কেন? দলের জন্য তো তিনি কম করেননি। সেটার প্রতিদান কি উনার প্রাপ্য না?’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ক্রিকেটারের ধারণা, ‘মাশরাফি ভাই রাজনীতিতে গেছেন বলেই কি সমালোচনা এত বেশি হচ্ছে? আমার তা-ই মনে হয়।’ ক্রিকেটে অবশ্য অতীত অবদানের কথা কেউ মনে-টনে রাখে না! বর্তমানেই কড়া নজরদারি সবার। নইলে মাশরাফির সঙ্গে তামিম ইকবালের অবসরের দাবিও কেন উঠবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে? শুনে আরেক ক্রিকেটারের বিস্ময়, ‘বলেন কি? তাই নাকি?’
গত বিশ্বকাপের পরের চার বছরে বাংলাদেশের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্ব ক্রিকেটেই সেরাদের কাতারে থাকা তামিমের একাদশে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন, তাদের কাছে সাত ম্যাচে মাশরাফির একটি মাত্র উইকেট তো রীতিমতো ‘অপরাধ’! হাবে-ভাবে বোঝা যাচ্ছে, সহসাই সে ‘অপরাধের সাজা’ নিজেই নিজেকে দেবেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। সেটা ৫ জুলাই ক্রিকেট-তীর্থ লর্ডস নাকি কোনো একদিন মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে, ছোট্ট একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলে আছে শুধু।