ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসে চলছে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপ। এই আসরে এবার খেলছে মাত্র ১০টি দেশ। সংখ্যাটি খুব সামান্য। বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্টারন্যশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল-আইসিসি। সংস্থাটির সদস্য দেশ মাত্র ১২টি। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়ে, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড আইসিসি’র পূর্ণ সদস্য। সম্প্রতি আফ্রিকান দেশ জিম্বাবুয়ে তাদের ক্রিকেট বোর্ড ভেঙে দিয়েছে।
ইংল্যান্ড ও এর আশপাশের বিভিন্ন দেশে একসময় ক্রিকেট জনপ্রিয় থাকলেও নানা কারণে এখন সেসব দেশের মানুষ ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। মজার ব্যপার হলো, ক্রিকেটের উৎপত্তি স্থল ইউরোপের মাত্র একটি দেশ ‘ইংল্যান্ড’ বিশ্বকাপে খেলছে। বিশেষ করে তথাকথিত উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে ক্রিকেট খেলা এখন আর পালে হাওয়া পাচ্ছে না। তবে এশিয়ার চিত্র ভিন্ন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এবারের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী ১০টি দেশের মধ্যে ৬টি দেশই দক্ষিণ এশিয়ার। অথচ আইসিসির সহযোগী সদস্য ১০৫টি দেশ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি, জাপান। এসব দেশে ফুটবল জনপ্রিয়, তবে তারা ক্রিকেট থেকে নিজেদের অনেকটাই দূরে সরিয়ে রেখেছে। এখন প্রশ্ন হলো কেন?
পৃথিবীর প্রথম অফিসিয়াল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। সেই যুক্তরাষ্ট্র বহু আগেই ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছে। যদিও সেখানে কিছু ক্লাব এখনও ক্রিকেট খেলে। ক্রিকেট সময়সাপেক্ষ খেলা। ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রচলন শুরু হওয়ার আগে ক্রিকেটে জয়-পরাজয় নিশ্চিত হতে ৪-৫দিন বা তারও অধিক সময় লেগে যেত। ১৮৬১-৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ চলে। এই সময় ক্রিকেট খেলার উপযোগী মাঠ পাওয়া কষ্টকর ছিল। তখন ক্রিকেটের আদলে সেখানে বেসবল-এর উদ্ভাবন হয়, যা অপেক্ষাকৃত কম সময় এবং ছোট মাঠে খেলা যায়। তারপর থেকে বেসবল সেখানে দর্শকপ্রিয় হতে থাকে। ৯০ মিনিটের খেলা ফুটবলও আমেরিকায় জনপ্রিয়। অধিক সময় লাগার কারণে ১ম বিশ্বযুদ্ধের পরে দেশটি ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
এশিয়ার দেশ চীন। উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো চীনে খুব বেশি সুবিধা করে উঠতে পারেনি। এ কারণে চীনে ক্রিকেট খেলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। এছাড়া দেশটি অলিম্পিক গেমসের প্রতি বেশি আগ্রহী। অলিম্পিকে খেলার তালিকায় ক্রিকেট নেই। এ কারণে চীনে ক্রিকেট খেলার গুরুত্ব নেই। দেশটিতে কিছু ক্লাব রয়েছে, তারা ক্রিকেট খেললেও আন্তর্জাতিকভাবে দেশটি ক্রিকেটের অঙ্গন থেকে অনেক দূরে।
ইউরোপের দেশ ফ্রান্স। ক্রিড়াঙ্গনে ফুটবল খেলুড়ে দেশ হিসেবে ফ্রান্সের বেশ পরিচিতি রয়েছে। তবে ক্রিকেটের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো। ক্রিকেট খেলা যখন আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করতে শুরু করেছে সেই সময়টা ছিলো ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের যুগ। ইংল্যান্ডের মতো ফ্রান্সও ছিল উপনিবেশবাদী রাষ্ট্র। সে কারণে এই দুই দেশ ছিল পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। ইংল্যান্ডের সংস্কৃতিকে ফরাসিরা ঘৃণার চোখে দেখতো। ফলে শুরু থেকেই ক্রিকেট খেলা ফ্রান্সে জায়গা দখল করতে পারেনি। বিশ শতকের শেষের দিকে সেদেশে ক্রিকেট খেলার প্রচলন শুরু হয়েছে। ২০০১ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়নশিপেও ফ্রান্স ক্রিকেট খেলেছে। এরপর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। এখনও ক্রিকেটকে ইংল্যান্ডের খেলা হিসেবে দেখে দেশটির জনগণ। তবে ইন্টারনেট এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনের বদৌলতে দেশটিতে ক্রিকেট ধীরে ধীরে পুনরায় জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। বিবিসির ২০১০ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটিতে যারা ক্রিকেট খেলে তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ ফরাসি এবং বাকিরা ইংরেজ, পাকিস্তানি, লঙ্কানসহ বিভিন্ন বিদেশি নাগরিক।
ইউরোপের দেশ রাশিয়ার জনগণের কাছে ক্রিকেট প্রায় অজানা একটি খেলা। দেশটির জনগণ ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে যৎসামান্য জানলেও এর নিয়ম-কানুন সম্পর্কে একেবারেই ওয়াকিবহাল নন। দেশটি ২০১৭ সালে আইসিসি’র সহযোগী সদস্য দেশের মর্যাদা পেয়েছে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার পূর্বে কিছু অভিজাতরা ক্রিকেট খেলতেন। কিন্তু ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা ক্ষমতায় আসে। এর পরের বছর ১৯১৮ সালে সেখানে ক্রিকেট নিষিদ্ধ করা হয়। সরকার ক্রিকেটকে বুর্জোয়াদের খেলা হিসেবে অভিহিত করে। বর্তমানে রাশিয়ায় যারা ক্রিকেট খেলেন তাদের অধিকাংশই বিদেশি। তবে ক্রিকেট নিয়ে রাশিয়ানদের আগ্রহ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ক্রিকেট জগতে জার্মানি মোটেও পরিচিত নাম নয়। দেশটিতে ১৮৫০ সালে প্রথম ক্রিকেট ক্লাব স্থাপিত হয়। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির ক্রিকেটে ভাটা পড়ে। নাৎসীদের কট্টর জাতীয়তাবাদের কারণে অনেক ক্রিকেটার ক্রিকেট থেকে ছিটকে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে সর্বশেষ ১৯৩৭ সালে হিটলারের একনায়কতন্ত্রের আমলে ইংলিশ ক্রিকেট দলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলে জার্মানি। এরপরই হিটলার জার্মানিতে ক্রিকেট নিষিদ্ধ করেন বলে জানা যায়। দীর্ঘদিন ক্রিকেট থেকে দূরে থাকার কারণে দেশটিতে ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। দেশটি ২০০১ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেয়।
দুনিয়ার সেরা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী দেশগুলোর মধ্যে জাপান অন্যতম। নিশীথ সূর্যের দেশে ক্রিকেট খেলা শক্তভাবে ঘাঁটি গাড়তে পারেনি। ১৮৬৩ সালে প্রথম ব্রিটিশ বণিক ও নাবিকরা সেখানে ক্রিকেট খেলে। কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে ব্যবসায়িক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে বেসবল জাপানে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। ফলে ক্রিকেটে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে জাপানিজরা। ১৯৮০-এর দশকে বিদেশি শিক্ষার্থী ও জাপানি শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্রিকেট টিম গঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে সেখানে জাতীয় ক্রিকেট দলও গঠিত হয়েছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি।