সরকারি সেবা নিতে সাধারণ মানুষ যেন কোনোভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হন, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোববার সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জেলা প্রশাসক সম্মেলন-২০১৯ উদ্বোধনকালে এ নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, এক সময় আমেরিকা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বা বটমলেস বাস্কেট বলতো। সেই আমেরিকাতে দারিদ্র্যের হার শতকরা ১৮ ভাগ। বর্তমানে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ২১ ভাগ।
শেখ হাসিনা বলেন, আরও অন্তত ৪ ভাগ দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আমেরিকার চেয়ে দারিদ্র্যের হার কমাতে হবে। এ ব্যাপারে তৎপর হয়ে ডিসিদের কাজ করার জন্য ওয়াদাবদ্ধ হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নয়নের ছোঁয়াটা যাতে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের কাছে পৌঁছায়, সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের উন্নয়ন শুধু মুষ্টিমেয় লোকের জন্য নয়। আমাদের সব উন্নয়ন পরিকল্পনা একেবারে গ্রাম পর্যন্ত।
তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে যেন মানুষের জীবনমান উন্নত হয়, দারিদ্র্যসীমা থেকে তারা উঠে আসতে পারে, সবার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, জীবনযাত্রা আরও উন্নত হয়, গ্রাম থেকে শহরে আসার প্রবণতাও যেন কমে যায়। সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের সব পরিকল্পনা। এক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন আপনারা।
দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে স্থানীয় সরকারকে আরও সক্রিয় করার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে হলে আমি মনে করি, স্থানীয় সরকার আরও সক্রিয় ও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
এসময় জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছে শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর ৩১ দফা নির্দেশনাগুলো হলো:
(১) ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী কেন্দ্রীয় পর্যায় হতে তৃণমূল পর্যন্ত উদ্যাপনের লক্ষ্যে আপনাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(২) ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে হবে।
(৩) সরকারি সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষ যাতে কোনোভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হন, সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে।
(৪) জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করে সর্বক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে আপনাদের আরও সতর্কতার সঙ্গে এবং কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
(৫) যুব সমাজকে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করতে মাদক বিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
(৬) গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনে আপনাদের ব্রতী হতে হবে।
(৭) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’র উন্নয়ন ও বিকাশে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে হবে। দৈনন্দিন প্রয়োজনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে জেলার সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
(৮) তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করতে হবে।
(৯) শিক্ষার সকল স্তরে নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় ত্যাগের হার হ্রাস এবং ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে।
(১০) ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সরকারি ভূমি রক্ষায় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
(১১) কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধিতে সার, বীজ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ইত্যাদির সরবরাহ নির্বিঘ্নে করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নিতে হবে।
১২) ভেজাল খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, পরিবহন ও বাজারজাতকরণ প্রতিরোধে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং এ ধরনের অনৈতিক কর্মকা- কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
(১৩) দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে।
(১৪) পরিবেশ রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এই সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধানের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
(১৫) প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় প্রশমনে ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২’ এবং এ সংক্রান্ত স্থায়ী নির্দেশনাবলি অনুসারে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
(১৬) সাধারণ মানুষকে সহজে সুবিচার প্রদান ও আদালতে মামলার জট কমাতে গ্রাম আদালতগুলোতে কার্যকর করতে হবে।
(১৭) জেলা প্রশাসকগণ জেলাপর্যায়ে বিভিন্ন কমিটির প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সকল কমিটিকে সক্রিয়, গতিশীল ও ফলপ্রসূ করতে হবে।
(১৮) দপ্তরসমূহের বিদ্যমান সেবাসমূহ তৃণমূলে পৌঁছানোর লক্ষ্যে তথ্য মেলা, সেবা সপ্তাহ পালনসহ ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
(১৯) শিল্পাঞ্চলে শান্তি রক্ষা, পণ্য-পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানি নির্বিঘ্ন করা এবং চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, পেশিশক্তি ও সন্ত্রাস নির্মূল করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(২০) বাজার-ব্যবস্থার সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। ভোক্তা-অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির যে কোনো অপচেষ্টা কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
(২১ নারী ও শিশু নির্যাতন এবং পাচার, যৌতুক, ইভটিজিং এবং বাল্যবিবাহের মত সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি’র জন্য আপনাদের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।
(২২) নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
(২৩) শিশু-কিশোরদের পুষ্টিচাহিদা পূরণ এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা, ক্রীড়া, বিনোদন ও সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংস্কৃতিবোধ ও বিজ্ঞানমনস্কতা জাগিয়ে তুলতে হবে।
(২৪) প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে।
(২৫) পার্বত্য জেলাসমূহের উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণের পাশাপাশি এ অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, বনাঞ্চল, নদী-জলাশয়, প্রাণিসম্পদ এবং গিরিশৃঙ্গগুলির সৌন্দর্য সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া, পর্যটনশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কুটিরশিল্পের বিকাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে।
(২৬) বর্জ্যব্যবস্থাপণায় কার্যকর ভুমিকা পালন করতে হবে। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের নদীগুলো দূষিত হয়ে গেছে। এখন থেকে পরিকল্পিত ভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
(২৭) জেলা সমূহের আকার ভিন্ন, জেলার আয়তন, জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, জেলার চাহিদা সব কিছু বিবেচনা করে উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে।
(২৮) স্থাানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, জনগণের কল্যান ও জীবন মান উন্নয়নের দিকে বিশেষ ভাবে লক্ষ্য রেখে উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচি নেওয়া।
(২৯) মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। স্কুল-কলেজের মাঠে নয়, আলাদা মাঠে মিনিস্টেডিয়ামের ব্যবস্থা করা, শহর থেকে একটু দূরে হলেও।
(৩০) গৃহহারা, ভূমিহীন- একটি মানুষ গৃহহারা থাকবে না। তাদেরকে পুনর্বাসন করা।
(৩১)সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিজড়া, বেদে ও প্রতিবন্ধীদের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। জলাধার সংরক্ষণের নিমিত্তে খাল খনন ও পুকুর খনন করতে হবে। পরিকল্পিত নগরায়ন ও বনায়ন নিশ্চিত করতে হবে।