নিজেরই গর্ভজাত সন্তানকে হত্যার দায়ে রাশিয়াতে প্রতিবছর বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন কয়েক ডজন মা। সন্তান হত্যাকারীদের এই তালিকায় অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন গৃহিণী থেকে শুরু করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সফল ব্যবস্থাপকও।
সন্তানকে খুন করবার এই ঘটনা কেবল রাশিয়াতেই ঘটছে না, আমেরিকাতেও প্রতি চার জনের একজন মা নিজের সন্তানকে মেরে ফেলতে চায় বলে জানাচ্ছে মনোবিজ্ঞানীরা। ২০১৪ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, অ্যামেরিকায় গত ৩২ বছরে যত খুন হয়েছে তার মোট ১৫ শতাংশই মূলত মায়ের হাতে শিশু সন্তানের মৃত্যুর ঘটনা।
ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসের তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে ২১ বছরে মোট ১১ হাজার শিশু অভিভাবকদের হাতে নিহত হয়েছে। গড়ে এই মৃত্যুর সংখ্যা বছরে ৩৪০টিরও বেশি। কিন্তু রাশিয়ার চিত্রটা যেনো আরো কঠিন। রাশিয়ায় টিকে থাকতে গেলে অনেক শক্ত ও অনমনীয় মনোভাবের হতে হয়। ফলে কেউ সেখানে তার মানসিক স্বাস্থ্য সংকট নিয়ে আরেকজনের সাথে সহজে কথা বলতে চায় না।
শিশু হত্যার এই কাহিনীগুলো মূলত দেখাচ্ছে যে, সন্তান জন্ম দেয়ার পরপরই অনেক মা সন্তান জন্মদান পরবর্তী বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়। কিন্তু পরিবারের নিকটজনেরা অনেকক্ষেত্রেই এই বিষণ্নতাকে চিহ্নিত করতে পারেন না। ফলে ঘটে দুঃখজনক পরিণতি।
মায়েরা কেন তাদের সন্তানদের খুন করেন সেই বিষয়ে রাশিয়ান নারীদের সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছেন বিবিসির সাংবাদিক ওলিসা গেরাসিমেঙ্কো ও স্ভেত্লানা রেইটার। তাদের অনুসন্ধান থেকেই জানা যায়, মাতৃত্বকে যেভাবে মহিমান্বিত করে দেখানো হয় সেই ভাবনায় বদল আনা দরকার।
আলোয়না পেশায় একজন অর্থনীতিবিদ। পিয়ত্রকে বিয়ে করে সুখী দাম্পত্য কাটানোর সময় সন্তান আগমনের খবরে তারা দু'জনেই খুব উৎফুল্ল ছিল। জন্মের আগেই শিশুর জন্য পোশাক-আশাক কেনা শুরু করেন তারা। শুধু তাই নয়, মাতৃত্ব ও শিশুর নানা বিষয়ে জানতে যোগ দেন প্রাক-প্রসবকালীন কিছু ক্লাসে। কিন্তু জন্মদানের পর মায়ের মানসিক সমস্যা কী কী হতে পারে - তা নিয়ে ক্লাসে কেউ কথা বলেনি। জন্মদানের পর আলোয়না ইনসমনিয়াতে আক্রান্ত হয় এবং সব মিলিয়ে তাল সামলাতে হিমশিম খেতে থাকে। এই পরিস্থিতিই ধীরে ধীরে মনোরোগ হিসেবে দেখা দেয় এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে ওষুধ সেবন শুরু করেন তিনি। একদিন পিয়ত্র বাড়ি ফিরে দেখে তাদের সাত মাসের শিশুটি পানিতে ডুবে মারা গেছে।
আর আলোয়নাকে পাওয়া যায় মস্কো শহরের সন্নিকটে একটি লেকের ধারে। পরবর্তীতে জানা যায়, নিজের সন্তানকে পানিতে ডুবিয়ে মারার পর আলোয়না নিজেও ডুবে মরতে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকেন। এখন তার বিচার কার্যক্রম চলছে।
রাশিয়ার অপরাধবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, নিজের সন্তানকে মেরে ফেলার আগে অন্তত ৮০ ভাগ নারী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং মাথাব্যাথা, ঘুমহীনতা ও অনিয়মিত মাসিকের ব্যপারে পরামর্শ নেন।
রাশিয়ার এটি একটি ট্যাবু। রাশিয়ান আইনে শিশু হত্যার বিষয়টি ট্যাবু-ক্রাইম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, যে পরিমাণ ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায় বাস্তবে তা ঘটে অন্তত ৮ গুণ বেশি।
ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিস্ট মার্গারিটা কাচেভা জানান, নিজের সন্তানকে মেরে ফেলেছে - এমন অন্তত তিন-চারজন প্রতিমাসেই তাদের হাসপাতালে আসে। বিবিসি যে মায়ের ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখেছে সেখানে হিসাবরক্ষক, শিক্ষক, বেকার নারী, সমাজকল্যাণ বিশেষজ্ঞ, রেস্টুরেন্টের কর্মী থেকে শুরু করে আরো নানা পেশার অন্তত ৩০জন নারী রয়েছে। অনেক নারী যারা তাদের সন্তানদের খুন করেছে তাদের স্বামী, সংসার, বাড়ি ও চাকরি রয়েছে এবং তারা কোন প্রকার নেশাতেও আসক্ত নয়। ডাক্তাররা বলেন, সন্তান জন্মদানের পরে, সুপ্ত মনোরোগ সহসাই বেড়ে যেতে পারে।
যে নারী গভীর বিষন্নতায় আক্রান্ত তার দৈনন্দিন কাজে-কর্মে যে এটি সবসময় প্রকাশিত হয় তেমন নয়। কিন্তু গর্ভধারণ, সন্তান জন্মদান ও মেনোপজের ঘটনায় তা হঠাৎই মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। আন্না নামের ৩৮ বছর বয়সী স্কুল শিক্ষকেরো রয়েছে এরকম আরেক কাহিনী। আন্না তার সন্তানকে বালিশ চাপা দিয়ে মারতে চেয়েছিল। পরে শিশুটিকে কোনমতে উদ্ধার করা হয় আর আন্নাকে পাঠানো হয় হাসপাতালে। সেখানেই ধরা পড়ে যে, আন্না ক্রনিক স্কিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত।
ড. কাচেভা বলেন, মনোরোগে আক্রান্ত হয়ে যে নারী তার সন্তানকে হত্যা করেছে তাকে যে দেখেই পাগল মনে হবে এমন নয়। বরং ঘটনাটি ঘটার আগ পর্যন্ত সে স্বাভাবিক জীবনই কাটাতে পারে। যেমন ২১ বছর বয়সী আরিনা। নিজের শিশুকে বুকে নিয়ে সে নয়তলা থেকে লাফিয়ে পড়েছিল। লাফিয়ে পড়ার পরেও অবিশ্বাস্যভাবে তারা দু'জনেই বেঁচে যায়। পুলিশ তাদের উদ্ধার করার পর আরিনাকে হাসপাতালে পাঠানোর হলে তারও স্কিজোফ্রেনিয়া ধরা পড়ে।
আমেরিকার মত রাশিয়াতেও আদালত দোষী মায়েদের নানান ধরণের শাস্তি দিয়ে থাকে। বিশেষত, হত্যাকারী মা যদি পাগল বলে প্রমাণিত না হয় তাহলে তার সাজা হতে পারে দীর্ঘ কারাবাস। বলা হচ্ছে, যে নারীরা সন্তানদের খুন করছে তারা নিজেরাও নিজেদের শৈশবে কোন না কোন ভাবে নিগৃহীত ছিলেন।
রাশিয়ান এক গবেষণা বলছে, হত্যাকারী মায়েদের মধ্যে অন্তত ৮০ ভাগই দরিদ্র পরিবারে বড় হয়েছেন এবং অন্তত ৮৫ ভাগই বিবাহিত জীবনে দ্বন্দ্ব ও কলহে জড়িত। গবেষকরা বলছেন, মিথ্য বলা, তর্ক করা, ঝগড়া করা এবং অ্যালকোহলে আসক্তির সাথে পরবর্তীতে শিশু হত্যার সম্পর্ক রয়েছে। আর নিজের বাবা-মায়ের সাথে যাদের সম্পর্ক জটিলতাপূর্ণ, তারাও পরবর্তীতে শিশুর প্রতি আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে।
হত্যাকারী মায়েদের অধিকাংশই আসলে আবেগীয়, যৌন ও শারীরিকভাবে কোন না কোনভাবে নির্যাতিত। অবশ্য অনেক আইনজীবী সন্তান হত্যাকারী মায়েদের পক্ষে মামলা নিতে চান না।
৩৩ বছর বয়সী তাতিয়ানা। সে নিজেও ওইসব হন্তারক মায়েদের তিরস্কার করতো। কিন্তু নিজে মা হবার পর তার দুনিয়াটাই একদিন বদলে গেলো। তার মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা দিলো এবং সে নিজেও নিজের সন্তানকে মেরে ফেলার কথা ভাবতো। ফলে, এই সংকট থেকে বাঁচতে সে একদিন চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়।
এই সব হত্যাকাণ্ড বন্ধের অন্যতম উপায় হিসেবে গর্ভধারণ নিরুৎসাহিত করা হয়। পাশাপশি রাশিয়ান ও পশ্চিমা ডাক্তারেরা মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে, বিশেষ করে, সন্তান জন্মদান পরবর্তী বিষণ্নতা নিয়ে মনোযোগী হবার পরামর্শ দিয়েছেন। ড. মার্গারিটা কাচায়েভা বলেছেন, রাশিয়ায় নারীদের সংকটকালীর ব্যবস্থার জন্য সেন্টার রয়েছে। কিন্তু সেগুলোও আধ-খালি পড়ে থাকে। কারণ রাশিয়ান নারীরা মনে করে যে, তার মানসিক সমস্যা নিয়ে কথা বললে হয়তো সন্তানকে তাদের থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হবে। সূত্র: বিবিসি