কয়েক হাজার বছর আগে মহান আল্লাহর কুদরতে সৃষ্টি হওয়া পবিত্র জমজম কূপের পানি বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রতিদিন ব্যবহার করছে। মুসলমানদের কাছে জমজমের পানি অত্যন্ত বরকতময় ও পবিত্র। জমজমের পানি পৃথিবীর সবচেয়ে বিশুদ্ধ পানি হিসেবে স্বীকৃত। মক্কার মসজিদুল হারাম ও মদিনার মসজিদে নববী থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০ লক্ষ গ্লাস জমজমের পানি পান করা হয়।
আজকে বিডিটাইমস৩৬৫ এর পাঠকদের জানবো আল্লাহর কুদরতের বাস্তব নিদর্শন পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা পানির উৎস জমজম কূপের অজানা অধ্যায় সম্পর্কে।
পবিত্র কাবা ঘর থেকে মাত্র ২১ মিটার দূরত্বে অবস্থিত আল্লাহর কুদরতের বাস্তব নিদর্শন জমজম কূপ। কাবা ঘরের সামনে হাযরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিমের মাঝ বরাবর রয়েছে জমজম কূপ। বর্তমানে জমজম কূপ মসজিদুল হারাম এর অভ্যন্তরে অবস্থিত।
হাদিসে এই পানির অশেষ কল্যাণ ও বরকতের কথা উল্লেখ রয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস মতে ভূপৃষ্ঠের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও কল্যাণকর পানি জমজম কূপের পানি। এইপানি ক্ষুধার্থের জন্য খাদ্য ও রোগীর জন্য পথ্য। জমজম কূপের পানির এই বিশেষত্ব বর্তমানে বিজ্ঞান দ্বারাও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। জমজমের পানি পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা পানি, শুধু তাই নয় এর সমান গুণাবলী সম্পন্ন পানি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সাধারণত যে কোন কূপের পানি দীর্ঘদিন আবদ্ধ ফলে তার রঙ ও স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু হাজার হাজার বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও জমজমের পানি রয়েছে সম্পর্ণ অবিকৃত এর রং সাদা ও বিশুদ্ধতায় সামান্যতম কোন পরিবর্তন আসেনি। এই পানিতে কোন জীবানু, শৈবাল-ছত্রাক বা পানি দূষণকারী কোন ধরনের বস্তু টিকতে পারে না।
কোন নদী ও জলাশয়ের সঙ্গে এই কূপের কোন সংযোগ নেই অথচ প্রতি মুহূর্তে লাখ লাখ মানুষ এই কূপের পানি ব্যবহার করছে, আবার অনেকেই সাথে করে নিয়েও যাচ্ছে তবুও জমজম কূপ কখনো শুকিয়ে যাবে না এবং এর পানি কখনো নষ্ট হবে না।
আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে মুসলিম জাতির পিতা নবী ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তার প্রিয়তমা স্ত্রী হাজেরা ও আদরের পুত্র ইসমাইলকে মক্কার বিরান পাহাড়ি এলাকায় নির্বাসনে রেখে আসেন। এই নির্বাসন ছিল আল্লাহর আদেশ মোতাবেক। সবচেয়ে প্রিয় কোন কিছুর কোরবানি এক মশক পানি ও এক থলে খেজুরসহ তাদেরকে বিরান মরুভূমিতে আল্লাহর উপর ভরসা করে রেখে আসেন। ফলে মক্কার মরুপ্রান্তরে একাকী বসবাস করতে থাকেন মা হাজেরা ও তার শিশুপুত্র ইসমাইল। তাদের স্বল্প রসদ অতি দ্রুতই ফুরিয়ে যায় একদিন নিদারুণ পিপাসায় শিশু পুত্র ইসমাইলকে খোলা প্রান্তরে রেখে মা হাজেরা সাফা-মারওয়া পাহাড়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন। সাতবার তিনি এদিক থেকে ওদিক ছুটে বেড়ান এক পর্যায়ে আল্লাহর হুকুমে হযরত জিবরাইল আলাইহিসসালাম মরুভূমির ভেতর থেকে পানির ঝরণা প্রবাহিত করে দেন। মা হাজেরা ইসমাঈল আলাইহিস সালামের কাছে এসে দেখলেন এক অভূতপূর্ব ঘটনা, শিশুপুত্র ইসমাইলের পায়ের আঘাতে শুকনো জমিতে তৈরি হয়েছে বিশুদ্ধ পানির স্রোত। তখন মা হাজেরা পানির চারদিকে বালির বাঁধ দিয়ে বললেন জামজাম অর্থাৎ থেমে যাও। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত জমজম কূপ বহাল রয়েছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে বলে মুসলমানদের দৃঢ়বিশ্বাস।
জমজম কূপের গভীরতা মাত্র ১০১ ফুট। কুপের পানির স্তর মাটি থেকে প্রায় সাড়ে দশ ফুট নিচে অবস্থিত। দুটি বিশাল আকারের পানির পাম্পের সাহায্যে প্রতি সেকেন্ডে ১১০০ লিটার থেকে ১৮৫০ লিটার পর্যন্ত পানি উত্তোলন করা হয়। পানি উত্তোলন করার পর এর স্তর ৪৪ ফুট নিচে নেমে যায়, কিন্তু পানি উঠানো বন্ধ করার মাত্র ১১ মিনিট পরেই আবারো পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে।
জমজমের পানির চাহিদা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকায় পানি সরবরাহে সৌদি কর্তৃপক্ষকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। সেজন্য ২০১০ সালে মক্কার কাদাই এলাকায় জমজমের পানি সরবরাহের জন্য বিশাল এক প্রকল্প তৈরি করা হয়। সৌদি আরবসহ বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে জমজমের পানি পৌঁছে দেয়ার জন্য এখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমজমের পানি বোতলজাত করা হয়। এখান থেকে প্রতিদিন সরবরাহ করা হয় ১ লক্ষ ৫০ হাজার লিটার জমজমের পানি, কিন্তু হজের মৌসুমে এই পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় দৈনিক ৪ লক্ষ লিটারে। এই প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ১০ লিটারের প্রায় ১৫ লক্ষ বোতল জমজম পানি সংরক্ষণ করা হয়। এখান থেকে পরবর্তীতে বিশেষ ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে মদিনার মসজিদে নববীসহ সৌদি আরবের অন্যান্য স্থানে পৌঁছে দেয়া হয় জমজমের পানি। কিছু কিছু স্থানে জমজমের পানি শীতলীকরণ করেও পরিবেশন করা হয়। দর্শনার্থীরা যাতে নিজেদের প্রয়োজনে জমজমের পানি নিয়ে যেতে পারে সে জন্য রয়েছে পৃথক ব্যবস্থা। এছাড়া মক্কা ও মদিনার ২ মসজিদের মুসল্লিদের সুবিধার্থে বহু স্বেচ্ছাসেবক জমজমের পানি পিঠে বহন করে সরাসরি পরিবেশন করে থাকে। সেই সাথে বিভিন্ন ছোট ছোট বোতলজাতকৃত পানীয় সরবরাহ করা হয়।
সৌদি আরবসহ অন্যান্য মুসলিম দেশে বাণিজ্যিকভাবে জমজমের পানি মজুদ ও কেনাবেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দুই পবিত্র মসজিদের অসংখ্য কর্মী সাধারণ মানুষের কাছে জমজমের পানি পৌঁছে দেওয়া ও এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
জমজমের পানি নিয়ে এখনো পর্যন্ত বহু গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে সৌদি আরবে জিওলজিক্যাল সার্ভের অধীনে জমজম স্টাডিজ এন্ড রিসার্চ সেন্টার নামে একটি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। ল্যাবরেটরীতে পরীক্ষা করে দেখা গেছে সাধারণ পানির তুলনায় জমজমের পানিতে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম সল্ট এর পরিমাণ বেশি যা ক্লান্তি দূর করতে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা রাখে।
ব্রিটিশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে জমজমের পানি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য শক্তি বর্ধক হিসেবে কাজ করে। সম্প্রতি মাসারু এমাটো নামের এক জাপানি গবেষক জমজমের পানি গবেষণা করে বলেছেন জমজমের এক ফোঁটা পানির যে নিজস্ব খনিজ গুনাগুন আছে তা পৃথিবীর অন্য কোন পানিতে নেই। তার গবেষণায় আরো দেখা যায় পৃথিবীর সাধারণ পানির তুলনায় জমজমের পানি এক হাজার গুন বিশুদ্ধ, আর তাই এক হাজার ফোটা সাধারন পানির সাথে যদি এক ফোটা জমজমের পানি মেশানো হয় তাহলে সেই সাধারণ পানিও জমজমের পানির মত বিশুদ্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ সাধারণ যে কোন পানির সাথে জমজমের পানি মেশালে সেই পানিও জমজমের পানির গুনাগুন অর্জন করে। বিশ্বের অন্য কোন পানিতে এ ধরনের আচরণ লক্ষ করা যায় না।