গোলাভরা ধান, খামারে মুরগি, ঘর-সংসার সবই ছিল। অভাব অনটন থাকলেও দিব্যি কাটছিল জীবন। কিন্তু আচমকাই একদিন গুপ্তচর হওয়ার ইচ্ছা মাথায় আসে। আর তাতেই বদলে যায় বিংশ শতাব্দির ইতিহাস। সিনেমার পর্দায় জেমস বন্ডের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে আগেই। এ বার চিনে নিন বাস্তবের ‘সুপারস্পাই’ হুয়ান পুজল গার্সিয়াকে।
১৯১২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি স্পেনের বার্সেলোনায় জন্ম হুয়ান পুজল গার্সিয়ার। কোথাও কোথাও জোয়ান পুজল গার্সিয়া নামেও পরিচিত তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে কাজ করতেন। তার পর শুরু করেন খামারে মুরগি পালনের ব্যবসা।
অন্যান্য ছোটখাটো ব্যবসাতেও হাত লাগিয়েছিলেন। কিন্তু পসার জমাতে পারেননি। তার মধ্যেই ১৯৩৬ থেকে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় স্পেনে। মুক্ত চিন্তাভাবনার মালিক হুয়ানকে সেই সময় গ্রেফতার করা হয়। ছাড়া পেয়ে ফের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলেও, কমিউনিজম এবং নাজিদের সর্বগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে, তৎকালীন স্পেন সরকারের বিরোধিতায় ব্রিটেনের হয়ে কাজ করতে আগ্রহী হন হুয়ান। কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার মতো শারীরিক শক্তি ছিল না তাঁর। তাই গুপ্তচর হবেন বলে মনস্থির করেন। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় তাতেও সুবিধা করতে পারেননি।
ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থা এমআই৫-এর দ্বারস্থ হলে, তাঁরাও একাধিক বার প্রত্যাখ্যান করেন তাঁকে। তাতে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন হুয়ান। স্পেনীয় অফিসার এবং হিটলারের সমর্থক সেজে মাদ্রিদে নাজি অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁদের হয়ে গুপ্তচর বৃত্তি করতে চান বলে জানান। সন্দেহ এড়াতে ভুয়ো কূটনৈতিক ভিসাও জোগাড় করে ফেলেছিলেন।
একেবারেই ইংরেজি বলতে পারতেন না গার্সিয়া। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর কথা বিশ্বাস করে নেন নাজি নেতারা। শুরু হয় তাঁর প্রশিক্ষণ। খরচ বাবদ ৪২ হাজার ডলারও হাতে পান, ভারতীয় মুদ্রায় বর্তমানে যা প্রায় ২৯ লক্ষ টাকা, যাতে লন্ডন গিয়ে আরও চর নিযুক্ত করতে পারেন।
কিন্তু শুধু টাকা নিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না! বিশ্বাস অর্জন করতে হলে জার্মানিকে তথ্যও পাচার করতে হবে! সেই মতো পড়াশোনা শুরু করে দেন তিনি। খবরের কাগজ, বিজ্ঞাপন ঘেঁটে যা পেতেন, যতটা সম্ভব বাস্তবসম্মত করে তা জার্মানিকে সরবরাহ করতেন তিনি। সেই সঙ্গে কিছু আসল তথ্যও পাঠাতেন।
লিসবন এবং মাদ্রিদে থেকেই এই কাজ করতেন হুয়ান। যদিও তিনি লন্ডন থেকে তথ্য পাঠাচ্ছেন বলে ভাবতেন নাজি অফিসাররা। তবে একেবারেই যে কোনও ভুল করেননি তা নয়। নাজি অফিসারদের তথ্য পাচারের সময় একবার বলে বসেন, গ্লাসগোয় এমন কিছু লোক রয়েছেন, যাঁরা ওয়াইনের জন্য সব কিছু করতে পারেন। আদতে জার্মান বিয়ার পছন্দ করতেন স্কটিশরা।
এর মধ্যেই ব্রিটিশ গুপ্তচরদের কানেও হুয়ান পুজল গার্সিয়ার খবর এসে পৌঁছয়। সন্ধান শুরু হলে নিজেই সামনে আসেন হুয়ান। তাঁকে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয়। সদস্য করে নেওয়া হয় এমআই৫-এর। নাম রাখা হয় ‘এজেন্ট গার্বো।’ তা সত্ত্বেও কিছু টের পায়নি জার্মানরা। বরং হিটলারের সমর্থনে ২৭ জন গুপ্তচর নিয়োগ করে ফেলেছেন বলে তাদের ভুয়ো তথ্য পাঠান হুয়ান। খরচ বাবদ মোটা টাকাও আদায় করেন।
গার্সিয়াকে এতটাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন নাজি অফিসাররা যে, তাঁকে বাদ দেওয়া বা মেরে ফেলার চিন্তাও করতে পারতেন না তাঁরা। ভাবতেন, গার্সিয়াকে সরিয়ে দিলে তাঁর তৈরি গুপ্তচর নেটওয়ার্কও যদি হাতছাড়া হয়ে যায়!
১৯৪৪-এর ৬ জুন উত্তর ফ্রান্স উপকূলের নরম্যান্ডিতে জার্মান সেনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মিত্রপক্ষ। আক্রমণ হতে পারে বলে আগেই খবর পৌঁছেছিল জার্মানির কাছে। কিন্তু গার্সিয়ার উপর ভরসা করে বসেছিল তারা।
সব কিছু জেনেও গার্সিয়া তাদের আশ্বস্ত করেন যে, নরম্যান্ডিতে আক্রমণের কোনও আশঙ্কা নেই। বোঝান, ইংলিশ চ্যানেল তথা আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে উত্তর সাগরের সংযোগসাধনকারী ডোভার প্রণালী হয়েই এগিয়ে আসছে মিত্রপক্ষের দেড় লক্ষ সেনার বাহিনী।
এই নরম্যান্ডি আক্রমণ থেকেই মিত্রপক্ষের জয়যাত্রা শুরু। তার এক বছর পরই সমাপ্তি ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। ইতিহাসবিদদের দাবি, ভুয়ো তথ্য দিয়ে হুয়ান পুজল গার্সিয়া জার্মানদের বিভ্রান্ত না করলে, মিত্রপক্ষের জয় সম্ভব ছিল না। আক্রমণের জন্য তৈরি ছিল না বলেই, জার্মান বাহিনীর ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে সময় লাগেনি।
নরম্যান্ডি আক্রমণের পরও এমআই৫-এর হয়ে কাজ করেছেন হুয়ান। জার্মানি নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করছে কিনা, সে খবর ব্রিটেনকে সরবরাহ করতেন তিনি। যুদ্ধ শেষে ইউরোপ ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে চেয়েছিলেন হুয়ান। প্রথমে ভেনেজুয়েলা গিয়ে পৌঁছন তিনি। কিন্তু শাস্তি এড়াতে বহু নাজি সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। পাছে তাদের কেউ তাঁকে চিনে ফেলে, তাই সেখান থেকে পালিয়ে আসেন তিনি।
যুদ্ধের পর সর্বদা প্রাণহানির আশঙ্কায় ভুগতেন হুয়ান। ১৯৪৮ সালে তাই নিজেই এমআই৫-এর হ্যান্ডলার টমি হ্যারিসকে ফোন করেন তিনি। ম্যালেরিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে ঘোষণা করে দিতে বলেন। তার এক বছর পর ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত সেই খবর স্পেনে পৌঁছে দেন।
এর পর ভেনেজুয়েলাতেই থাকতে শুরু করেন হুয়ান। তবে লম্বা দাড়ি ও চোখে চশমা এঁটে ভোল পাল্টে ফেলেন তিনি। সেখানে একটি বইয়ের দোকান চালাতেন তিনি।
১৯৭১ সালে এজেন্ট গার্বোকে নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়েন ব্রিটিশ রাজনীতিক রুপার্ট অ্যালাসন। নাইজেল ওয়েস্ট ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন রুপার্ট। অনেক চেষ্টার পর ১৯৮৪ সালের ২০ মে হুয়ান পুজল গার্সিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাঁর। সে বছরই ৬ জুন মিত্রপক্ষের নরম্যান্ডি দখলের ৪০ বছর পূর্তিতে সেখানে যান হুয়ান। ১৯৮৮ সালে মৃত্যু হয় হুয়ানের।
দু’বার বিয়ে করেছিলেন হুয়ান। প্রথম স্ত্রী আরাসেলি গঞ্জালেজ কারবালো এবং দ্বিতীয় স্ত্রী কারমেন সিলিয়া আলভারেজ। দুই ছেলে ও এক মেয়ে তাঁর। তবে ১৯৭৫ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে মৃত্যু হয় হুয়ানের মেয়ের। হুয়ান পুজল গার্সিয়াকে নিয়ে একাধিক তথ্যচিত্র ও ছবি তৈরি হয়েছে।