বরগুনার চাঞ্চল্যকর রিফাত হদ্যার প্রধান আসামি, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত নয়ন বন্ডের হাতে ঠিক কতজন তরুণীর সর্বনাশ হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই পুলিশের কাছেও। তবে নয়নের ‘বিশেষ কক্ষ’ থেকে উদ্ধার একটি ল্যাপটপে বহু পর্নো ভিডিও পাওয়া গেছে।
কয়েকটি আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি পর্নো ভিডিওতে নয়ন বন্ডের সঙ্গে একাধিক তরুণীর অন্তরঙ্গ মহূর্তের দৃশ্য রয়েছে। এসব দৃশ্যে নয়নের চেহারা স্পষ্ট বোঝা গেলেও তার শয্যাসঙ্গী তরুণীদের মধ্যে কারও কারও চেহারা অস্পষ্ট। একেক দিন একেক জন তরুণী নিয়ে সে যে ফুর্তিতে মেতে উঠেছিল তা স্পষ্ট।
পুলিশের সূত্র বলছে, নয়ন বন্ডের ওই বিশেষ কক্ষের গোপন জায়গায় সুকৌশলে আইপি ক্যামেরা (ইন্টারনেট ক্যামেরা) বসানো থাকত।
শয্যাসঙ্গী হওয়ার জন্য নয়ন বন্ড যাদের ওই কক্ষে আনতেন তারা কেউ ক্যামেরার অস্তিত্ব টের পেতেন না। একবার নয়নের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়ার পর ওই মেয়ের আর রক্ষা ছিল না।
ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে বারবার কিশোরী- তরুণীদের ব্যবহার করত সে। অনেক তরুণী নয়নের হাত থেকে বাঁচতে কলেজ ছাড়তে পর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন।
অনেকে আবার নয়নের চাহিদামতো মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। পুলিশের হাতে এমন অন্তত ১২ জন তরুণীর তথ্য আছে বলে জানা গেছে।
নয়ন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কে বা কারা এসব ভিডিও ছড়াচ্ছে তার সন্ধান করতে পারেনি পুলিশ। নয়ন বন্ডের বাড়ি বরগুনা শহরের ডিকেপি রোডের মাঝ বরাবর একটি সরু গলির শেষ প্রান্তে। বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা খালি।
বাড়ি নির্মাণের জন্য সম্প্রতি সেখানে অনেক ইট এনে রাখা হয়েছে। নয়নের বাড়ির মূল দরজার পাশেই একটা ছোট্ট বৈঠক ঘর। নয়ন সেখানেই থাকত। গভীর রাত পর্যন্ত ঘরের দরজা খোলা থাকত। সারা দিন এখানে-সেখানে ঘোরাঘুরির পর গভীর রাতে বাড়ি ফিরত।
রাত ১২টার পর তার কক্ষে লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যেত। আসতেন পুলিশের সদস্যরাও। প্রতিবেশীরা বলছেন, পুলিশের কয়েকজন অসাধু সদস্য মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা নয়নকে ব্যবহার করে নির্বিঘ্নে মাদক ব্যবসা চালিয়ে গেছেন। শহরের অনেকেই মাদকের সঙ্গে যুক্ত ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের চেনেন- জানেন। কিন্তু কেউ-ই মুখ খুলতে নারাজ।
কথা হয় ঢাকায় কর্মরত র্যাবের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, রাজধানীতে বসে বরগুনা শহরে নয়নের ত্রাস বোঝা যাবে না। ঢাকার মাস্তান আর মফস্বল জেলা শহরের মাস্তানের মধ্যে ব্যাপক ফারাক আছে। ঢাকার মাস্তানদের কেউ ভয় পায়, আবার কেউ পায় না। কিন্তু জেলা শহরের মাস্তানকে ভয় না পেয়ে উপায় নেই। কারণ সেখানে বিচার পাওয়ার পথ সীমিত। একবার মাস্তানের হাতে নাজেহাল হলে তার সবকিছুই শেষ। মান-সম্মান নিয়ে তার বেঁচে থাকাই দুরূহ হয়ে ওঠে। ফলে মফস্বল শহরে নয়নের মতো মাস্তানরা ভয়ংকর ক্ষমতাধর।
সূত্র বলছে, মাদক ব্যবসায়ী নয়ন নিজেও মরণ নেশা ইয়াবায় আসক্ত ছিল। কলেজ ঘেঁষা তার বাড়িটিকে প্রকাশ্যেই সে মাদক বিক্রির প্রধান কেন্দ্রে পরিণত করে। রিফাত শরীফ হত্যার আগের দিন পর্যন্ত পুলিশ সবই জানত। কিন্তু কোনো কথা বলেনি বা বলার সাহস করেনি।
রিফাত শরীফ হত্যার মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা চেপে যেতে না পারায় প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। শেষ পর্যন্ত পুলিশের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা নয়নকে খুঁজে বের করে সেই পুলিশই। শহরের বাসিন্দারা এমনও বলছেন, নয়ন চাইলে যে কাউকে পুলিশ দিয়ে হয়রানি বা গ্রেফতার করাতে পারত।
থানা পুলিশের সঙ্গে তার বিশেষ সখ্য ছিল। কাজ করত পুলিশের বিশ্বস্ত সোর্স হিসেবে। নয়নের বেড়ে ওঠা নিয়ে কথা হয় শহরের কলেজ রোডের বাসিন্দা মনির হোসেনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, নয়ন বন্ড প্রথমে ছিঁচকে চোর ছিল। একপর্যায়ে মেয়েদের হ্যান্ডব্যাগ, মোবাইল ফোন নিয়ে দৌড় দিত। তবে নিষিদ্ধ মাদকের জগতে ঢুকে সে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। বছর খানেক ধরে জেলার প্রভাবশালী লোকজনের সঙ্গে নয়নের ওঠবস শুরু হয়। কয়েক মাস ধরে সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
কলেজের সামনে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বসে থাকত। কলেজের ছাত্রছাত্রীদের আটকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিত। না দিলে বেদম মারধর করত। কলেজের ছাত্রাবাসে যখন-তখন দলবল নিয়ে ঢুকে তাণ্ডব চালাত নয়ন বন্ড।
বরগুনা শহরে সাধারণ লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নয়ন বন্ডের ক্ষমতার উৎস শহরের কারও কাছেই অজানা নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা সমাবেশে নয়নকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে দেখা গেছে। বখাটে নয়নকে নষ্ট রাজনীতিতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন অসাধু রাজনীতিকরা।
অথচ নয়নের মা সাহিদা বেগমের দাবি- নয়ন লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী ছিল। ক্লাস ফাইভ ও এইটে সে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিও পেয়েছে। এসএসসিতেও ভালো ফল করে। কিন্তু কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই নেশার জগতে ঢুকে পড়ায় লেখাপড়ায় গতি হারায় সে।
সাব্বির আহমেদ নয়ন থেকে বনে যায় ‘নয়ন বন্ড’। শেষ পর্যন্ত ক্রসফায়ারে নয়ন বন্ডের অধ্যায়ের শেষ হয়। কিন্তু বরগুনায় আরও অনেক নয়ন রয়েছে, যারা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বাজার রোডের বাসিন্দা আজিজুল হক প্রতিবেদককে বলেন, আপনারা নয়ন বন্ডের বাড়িতে গিয়ে দেখবেন সবকিছুই ভাঙা। গ্রেফতার অভিযানের সময় এগুলো পুলিশ ভেঙেছে। ক্যামেরাগুলোও ভেঙেছে। কেননা ক্যামেরাগুলো থাকলে অনেক পুলিশের মুখোশ খুলে যেত।
শহরের বাজার রোডের আরেক বাসিন্দা বলেন, নয়নের মনোরঞ্জনে ব্যবহৃত অনেক তরুণীকে পরে পুলিশের মনোরঞ্জনে ব্যবহৃত হওয়ার কথা শোনা গেছে। বিনিময়ে পুলিশের উদ্ধার করা মাদকের ভাগ পেত নয়ন।
বরগুনা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, নয়নের শোবার ঘর থেকে যে ল্যাপটপটি উদ্ধার করা হয়েছে সেখানে কয়েকশ’ পর্নোগ্রাফি রয়েছে। স্থানীয় অনেক তরুণী যে তার শিকারে পরিণত হয়েছেন ল্যাপটপের ওই ভিডিও-ই তার প্রমাণ।
জেলা পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এসব ভিডিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন।
নয়ন বন্ডকে নিয়ে কথা হয় তার মা সাহিদা বেগমের সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ছেলেকে ভালো করার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু একা একা পারিনি। আমার দুটো ছেলে। একটা বিদেশে থাকে। স্বামীকে হারিয়েছি অনেক আগে। নয়নকে সঙ্গে নিয়ে থাকতাম। কিন্তু নয়ন নেশাগ্রস্ত হয়ে গেল। ছেলেকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে পারিনি।
বলতে পারেন আমি একজন ব্যর্থ মা। তিনি বলেন, তবে ছেলেটা অপরাধী হলে আইনের হাতে তুলে দিতে পারত। তার বিচার হতো। আদালত যে শাস্তি দিত তা সে ভোগ করত।
কিন্তু তাকে ক্রসফায়ারের নামে মেরে ফেলল। কেন তাকে মেরে ফেলা হল। তাকে যারা নয়ন বন্ড বানিয়েছে তাদের আড়াল করতেই কি তাকে মেরে ফেলা হল। এ প্রশ্ন আমি কার কাছে করব। আমার কি সেই অধিকার আছে। আমার কথা কি কেউ শুনবে। এক সন্ত্রাসীর মায়ের অভিযোগ কি কেউ আমলে নেবে?