রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। গেল কয়েক বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে দশ হাজারের বেশি নারী-পুরুষ ও শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ায় তখন রেকর্ড হয়েছিল। ২০১৯ সালে সাত মাসেরও কম সময়েই ডেঙ্গু আক্রান্তে গেল বছরের রেকর্ড ভঙ্গ হতে চলছে। রাজধানী ঢাকার হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগীর ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
চলতি বছরে বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৯ হাজার ২শ ৫৬ জন। তাদের মধ্যে এই জুলাই মাসেই সর্বোচ্চসংখ্যক ৭ হাজার ১শ ১২ জন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
হাসপাতালগুলোতে বলতে গেলে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে। কারণ কোন জায়গায়ই বেড খালি নেই। সরকারি হাসপাতালে বারান্দায় অতিরিক্ত বেড দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা চলছে। অনেক রোগীকে ফেরত দেয়া হচ্ছে - বলছিলেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সাবেক ডীন ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ।
তিনি জানান, এ মৌসুমে কয়েক হাজার ডেঙ্গু রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি।
এ বছর তো অনেক রোগী দেখলাম, সেই জানুয়ারি থেকে শুরু করেছি। মে জুন থেকে তো ডেইলি প্রচুর রোগী দেখছি। প্রতিদিনই বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীরা ভিড় করছেন, অনেকেই সিটের অভাবে ভর্তি হতে পারছেন না - বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
যেখানে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হওয়ার কথা না যেমন নিউরোলজি ওয়ার্ড, সিসিইউ ইত্যাদিতেও বেড দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে," বলেন তিনি।
ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে বেড পেতে ভোগান্তির কথা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন একজন চাকরিজীবী শারমীন নিপা।
তার ৫ বছর বয়সী মেয়ে, ছোট বোন, ছোট ভাইসহ পরিবারের তিন সদস্য ডেঙ্গুতে আক্রান্ত । এরমধ্যে ছোট ভাই চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরলেও চার দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে ছোট বোন। নতুন করে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন তার বাবা। ধারণা করা হচ্ছে, তিনিও ডেঙ্গুতেই ভুগছেন।
তিনি বলেন, আমার বোন যখন ভর্তি হয় ওর ১০৩ বা ১০৪ জ্বর ছিলো। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ওরা সিট দিতে পারছিলো না। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে কোন রকমে একটি ওয়ার্ডে সিট ম্যানেজ করে তারপর ভর্তি করি।
ডেঙ্গু রোগের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম বলেছে, গত ২৪ ঘণ্টাতেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৪৭ জন। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত এই সংখ্যা ৯ হাজার ২৫৬ জন।
সরকারি হিসাব বলছে, এবছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৮ জন। তবে, বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি।
অন্যদিকে ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এডিস মশা নির্মূলের কার্যকর প্রক্রিয়া জানাতে দুই সিটি কর্পোরেশনকে আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন হাইকোর্ট।ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান দুই স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে তলবের পর তারা আদালতে উপস্থিত হলে এক শুনানির পর এই নির্দেশ দেয় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।
গত ২২ জুলাই মশা মারার কার্যকর ওষুধ আনার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।আজ আদালতে হাজির হওয়ার পর তাদের বক্তব্য শুনেছেন আদালত। পরে সে প্রেক্ষাপটে মশা মারার ওষুধ নিয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সায়রা ফায়রোজ বলেন, "হাইকোর্ট বলেছেন, কী ওষুধ দিলে মশা মারা যাবে? কারণ রোগটা তো এখন মহামারী আকার নিয়েছে।
তখন সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বলেন, তারা যে ওষুধ দেন তার ডোজ দ্বিগুণ করে তারা দেখতে চান - একটি নির্দিষ্ট এলাকায় মশা মরে কিনা। এজন্যই তারা সময় চেয়েছে। হাইকোর্ট আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত সময় দিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হলেও ইতোমধ্যে সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ছয় হাজার ৯শ ২৬ জন। বর্তমানে রাজধানীসহ সারাদেশের হাসপাতালে ২ হাজার ৩শ ২২ জন চিকিৎসাধীন রয়েছে।
ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হালনাগাদ চিকিৎসা গাইডলাইন প্রণয়নের পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাসহ সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার সংখ্যা কমানোর জন্য বিদেশ থেকে একধরনের মশা আমদানি করার চিন্তা-ভাবনা চলছে।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ তত্ত্ব নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর,বি) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জাদি সাবরিনা ফ্লোরা বলেন, সংবাদ মাধ্যম বা অন্যান্য যে কেউ ডেঙ্গুতে মারা যাওয়ার দাবি করলেও রোগ তত্ত্ব ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে গঠিত কমিটি মারা যাওয়ার সঠিক কারণ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছে এমন ঘোষণা দিতে পারেন না।
তিনি বলেন, আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আমাদের কাছে মাত্র ৮ জন মারা যাওয়ার সংবাদ রয়েছে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ৫৪৭ জন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এদিকে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য মহাপরিচালক ডেঙ্গু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দাবি করলেও রাজধানীস সারাদেশের মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সরকারি হিসেবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৮ জন বলা হলেও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মৃতের সংখ্যা কমপক্ষে তার তিনগুণ হবে ।