সাফল্যের পেছনে ছুটতে ছুটতেই অনেকের জীবন পার। অভীষ্ট লক্ষ্য থেকেই যায় সোনার হরিণের মতো অধরা। অনেকে হতাশ হয়ে কেবল ভাগ্যকেই দোষারোপ করে যান। নিজের সঙ্গে সফল ব্যক্তিকে মিলিয়ে বারবার প্রশ্ন করেন, ‘কী এমন করেছেন তিনি, যা আমি করিনি?’ সফল মানুষেরা কীভাবে লক্ষ্যে পৌঁছান? এর পেছনে কী প্রেরণা-উদ্দীপনা কাজ করে? উত্তরে বলা যায়, অবশ্যই প্রেরণা তাঁদের শক্তি জোগায়।
তাঁরা কি কঠোর পরিশ্রম করেন? এর জবাবও ‘হ্যাঁ’বোধক। ভাগ্য কি সহায় হয়? এর উত্তরেও বলা যায়, লক্ষ্য ঠিক করে উদ্দীপনা নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করা মানুষদের অবশ্যই ভাগ্য সহায়তা করে। তবে এই সফল মানুষেরা তাঁদের সফলতার গল্প বলতে গিয়ে একটি অভ্যাসের কথা প্রায়ই উল্লেখ করেন।
সফল ব্যক্তিদের সাফল্য নিয়ে নানা গল্পের মধ্যে একটি অভ্যাসের মিল খুঁজে পেয়েছে জার্মানির বার্লিনভিত্তিক ডিজিটাল সাময়িকী ব্লিনকিস্ট। পাক্ষিক এই ম্যাগাজিনের মতে, সফল ব্যক্তিরা প্রচুর বই পড়েন। বিশ্বের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তা, যাঁরা সফলতার শিখরে পৌঁছেছেন, তাঁদের বই পড়ার অভ্যাস রয়েছে। বেশির ভাগ সফল মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বছরে গড়ে ৬০টি করে বই পড়েন।
বিশ্বের সেরা আর উজ্জ্বল ব্যক্তিদের মনে সব সময় নতুন নতুন ধারণার জন্ম নেয়, সেসবই তাঁরা বিজ্ঞতার সঙ্গে প্রয়োগ করেন। তাঁদের জীবন ও পেশার সঙ্গেও মিলেমিশে যায় সেসব ধারণা। এই সাময়িকী মনে করে, কেউ যদি মার্কিন অনলাইন গণমাধ্যম দ্য হাফিংটন পোস্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রধান সম্পাদক ৬৮ বছর বয়সী আরিয়ানা হাফিংটন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের সিইও ৩৪ বছর বয়সী মার্ক জাকারবার্গের কাতারে নিজের নামটি যুক্ত করতে যান, তাহলে বই পড়ার অভ্যাস তাঁকে সহায়তা করতে পারে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বংশোদ্ভূত প্রভাবশালী মার্কিন ব্যবসায়ী মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের (এই প্রতিষ্ঠানের রকেটে করে মহাকাশযাত্রা করেছে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১) প্রধান নকশাবিদ ও সিইও প্রকৌশলী অ্যালন রিভ মাস্কের মতে, বই পড়েই তিনি রকেট বানানো শিখেছেন। স্পেসএক্সের একজন প্রতিনিধি জিম কানট্রেল অ্যালন মাস্ক সম্পর্কে বলেছেন, ‘যখন অ্যালন মাস্ককে কেউ জিজ্ঞেস করেন, কীভাবে রকেট নির্মাণ করা শিখেছেন? উত্তরে তিনি বলেন, বই পড়ে। আমি তাঁর মতো এত স্মার্ট কাউকে কখনো দেখিনি।’
বিশ্বের আরেক প্রভাবশালী বহুজাতিক মার্কিন প্রতিষ্ঠান বার্কশায়ার হাথাওয়ের সিইও এবং শীর্ষ ধনী ওয়ারেন বাফেট তো গোগ্রাসে বই পড়েন। প্রতিটি শিল্পের ক্ষেত্র সম্পর্কে তাঁর জানার আগ্রহ ব্যাপক। বিভিন্ন শিল্প সম্পর্কে জানতে তিনি প্রচুর বই পড়েন। বই পড়ার অভ্যাস সম্পর্কে ওয়ারেন বাফেট বলেন, ‘প্রতিদিন ৫০০ পৃষ্ঠা পড়ুন। এভাবেই জ্ঞানের চর্চা হয়। এটা অনেকটা বিনিয়োগের দ্বিগুণ উঠে আসার মতো। আপনারা প্রত্যেকেই এটা করতে পারেন। তবে আমি নিশ্চিত, আপনারা অনেকেই এই কাজটি করবেন না।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মোগল মার্ক জাকারবার্গ ২০১৫ সালে নিজের জন্য বুক ক্লাব গড়ে তোলেন। তিনি বলেন, ‘বই আপনাকে একটি বিষয় সম্পর্কে পুরোপুরি জানাবে এবং যেকোনো মাধ্যমের চেয়ে বই-ই আপনাকে গভীরভাবে আবিষ্ট করতে পারবে।’
বেশির ভাগ সিইও বছরে গড়ে ৬০টি বই পড়েন। এর অর্থ, প্রতি মাসে তাঁরা গড়ে পাঁচটি বই পড়েন। কারণ? তাঁরা জানেন, যেসব সমস্যার মুখোমুখি তাঁরা হয়েছেন, তা আগেও কেউ না কেউ হয়েছেন। কেউ না কেউ সেই সব সমস্যার সমাধান পেয়েছেন এবং তা লিখে গেছেন। তাই সফল সিইওরা খুব ভালোভাবেই বোঝেন, বই হলো ব্যবসার জন্য সবচেয়ে ভালো স্কুল। তাঁরা বড় পরিবর্তনের জন্য নতুন কোনো পন্থা আবিষ্কার করেননি। তাই বইয়ের মধ্যে খুঁজে নেন সমস্যা সমাধানের চাবি।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারেন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। অতি ব্যস্ততার মধ্যেও নিয়ম করে তিনি লোভীর মতো যে কাজটি করেন, তা হলো বই পড়া। তিনি সপ্তাহে অন্তত একটি বই পড়েন এবং সফল হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদেরও বই পড়ার পরামর্শ দেন। বিল গেটস বলেন, ‘অফিস, বাসা বা রাস্তা, যেখানেই থাকি না কেন, আমার সঙ্গে বইয়ের স্তূপ থাকে, আমি বই পড়তে থাকি।’
এরপর হয়তো ‘সময় পাই না বলে বই পড়তে পারি না’—এমন অজুহাত আর ধোপে টেকে না। অর্থনৈতিকভাবে সফল ৮৮ শতাংশ মানুষ প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট বই পড়েন।
লেখক টম করলে তাঁর ‘চেঞ্জ ইওর হ্যাবিট, চেঞ্জ ইওর লাইফ’ (অভ্যাস পাল্টান, জীবন পাল্টান) বইয়ে নিজের চেষ্টায় সফল হয়েছেন—এমন ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার তুলে ধরেছেন। বইয়ে ৮৮ শতাংশ সম্পদশালী বলেছেন, তাঁরা প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট বই পড়েন। তাঁরা তথ্যভিত্তিক বই, বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী, ইতিহাস এবং আত্মসহায়ক বই পড়েন। বই থেকে তাঁরা যা শেখেন, তা তাঁদের প্রতিদিনের জীবনকে আরেকটু ভালো করে। যার ফলে এসেছে সাফল্য। সূত্র: প্রথম আলো