বন্ধুত্বের হয়না কোন সীমানা। আর তাই সীমানা পেরিয়েই হয় বন্ধুত্ব। কিন্তু এখন থেকে দুই যুগ আগে যদি চিন্তা করি, যখন দেশে বর্তমানের মত ছিল না ইন্টারনেটের ছোঁয়া। চাইলেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিশ্বের যে কোন প্রান্তের কারো সাথে যোগাযোগ বা বন্ধুত্ব করাও সম্ভব ছিল না। কিন্তু বন্ধুত্ব ঠিক তখনও সীমানা পেরিয়ে ছিল।
নতুন নতুন জায়গা ভ্রমন করা আর নতুনকে জানার পিপাসা কিছু মানুষের সব সময়। তাদেরই একজন যার জন্ম পকিস্তানের ইসলামাবাদে হলেও বাংলাদেশ তাকে টেনেছে সবসময়। আর তাই অপরুপ বাংলার প্রকৃতির টানে এদেশেই রয়ে গেছেন বাবার চাকুরির সুবাদে। কুমিল্লা শহরের ঝাউতলায় গড়েছেন নিজ বাসস্থান। ১৯৮৬ সালে দেশ বিদেশ ঘুরতে ঘুরতে জাপানের পথেই বন্ধুত্ব হয় তাকানোরীহিতুমি এর সাথে।
ভাল বন্ধুত্বের সুত্র থেকেই আসে দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশের বাজারে ব্যবসার আইডিয়া। হাতে না আছে তেমন অর্থ যা দিয়ে বিদেশের বাজারে ব্যবসা করবেন তিনি। তার পরও থেমে থাকেন নি। এমন কিছু নিয়েই বিদেশের বাজারে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুতি নেন যা তখন দেশের বাজারে ফেলনা হিসেবেই ব্যবহার হয়। গার্মেন্টস ব্যবসা তখন দেশে তেমন সমৃদ্ধির পথ দেখেনি বললেই চলে।
গার্মেন্টস এর ফেলে দেওয়া কাপড় বা জুট কি বিদেশে রপ্তানী করা সম্ভব। আপনি আমি শুনলেই হয়ত বলে উঠব তা কি করে। সেলাই করে রুমালের মত তৈরী করে তাও যে বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশীক মুদ্রা আয় করা সম্ভব, সর্বপ্রথম বাংলাদেশে সেটাই প্রমান করে দেখিয়েছেন ভ্রমন পিপাসু খন্দকার মিকি। জাপানের মানুষ এই সেলাই করা জুটের রুমাল ঘর গৃহস্থলির আসবাবপত্র পরিস্কার করার কাজে ব্যবহার করে।
জাপানী বন্ধুর সহযোগীতায় সর্বপ্রথম বায়ারের সন্ধান পেয়ে যান তিনি। ফ্যাক্স প্রেরন আর প্রহনের মাধ্যমেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন নিয়মিত। কিন্তু ফেলনা জুট বাংলাদেশে তখনও কিনতে হত। কারন গাড়ি সহ বিভিন্ন মেশিন ও যন্ত্রপাতির ময়লা তেল-কালি মোছার কাজে ব্যবহার হত এ জুট। হাতে খুব বেশী অর্থ না থাকলেও থেমে থাকার পাত্র তিনি ছিলেন না। অক্লান্ত পরিশ্রম করার মত সামর্থ্য আর লেগে থাকার মত ধৈর্য্য ছিল তার।
১৯৯৫ সালে সর্বপ্রথম টুকরো টুকরো জুট সেলাই করে নির্দিষ্ট আকৃতির রুমাল তৈরীর জন্য যাত্রা শুরু হয় মাত্র দুইটি সেলাই মেশিন নিয়ে। টানা এক বছর গার্মেন্টস জুট সেলাই করে এক কন্টেইনার রুমাল তৈরী করার জন্য প্রানান্তকর প্রচেষ্টা চলে। তার পরও দশ টন ওজনের এক কন্টেইনার মাল তৈরী করতে পারেননি তিনি। বিদেশে লেনদেন করার জন্য সব ধরনের বিষয়ই ছিল তার অজানা। তখনও পর্যন্ত ছিল না কোন ব্যাংক এ্যাকাউন্ট।
বিদেশ থেকে এলসি পেলেন। মাল সরবরাহ করার জন্য দিন গোনারও শুরু হল। সেই সাথে রপ্তানী সংশ্লিষ্ট সকল কাগজ পত্রও সংগ্রহ করার জন্য দৌড়াতে হল। কিন্তু তখন তার যা জনবল আর সম্পদ তাতে সঠিক সময়ে মাল সরবরাহ করা অসম্ভব ছিল প্রায়। চেষ্টা চালিয়ে গেলেন দিনরাত। ব্যার্থও হলেন, সময়মত মাল সরবরাহ করতে পারলেন না। বায়ারকে ম্যানেজ করে দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় সফল হলেন ১৯৯৬ সালে। ব্যাংকে তার অর্থ এসে পৌছাল আর বায়ারও সন্তুষ্টির ঢেকুর তুলল মাল হাতে পেয়ে।
এবার নতুন করে স্বপ্ন দেখার শুরু হল। বাড়ানো হল কারখানার আয়তন আর মেশিনের সংখ্যা। অধিক লোকবল নিয়ে যাত্রার নতুন পথে অগ্রসর হতে না হতেই ধাক্কা। একদিকে তৈরী করা পাহাড় সমান বিশাল মালের স্তুপ জমানো আর অন্যদিকে বায়ার চলে যাওয়া। তার ওপর কর্মীদের বেতন আর কারখানা গোডাউনের ব্যয় বহন। সামলে উঠবেন কিভাবে বুঝতে পারছিলেন না। চলতি ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল তার। চোখে সরষে ফুল দেখলেও হাল ছাড়ার পাত্র তিনি না।
দিন রাত গিয়ে পড়ে থাকতেন চেম্বার অব কমার্সে বায়ার সংগ্রহের আশায়। ততদিনে ব্যবসা বন্ধের প্রায় এক বছর হয়ে গেছে। ধৈর্য্য তার যখন বাধ ভাঙার মত অবস্থা, হাল এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছেন ঠিক তখনই দেখা মিলল সুদিনের। এক বছরেরও বেশী সময় পর দেখা পেলেন বায়ারের। শুরু হল নতুন করে যাত্রার। ব্যবসার প্রতিযোগীরাও প্রবেশ করতে শুরু করল দিনে দিনে। সেই থেকে নানা ঘাত প্রতিঘাতে টিকে থেকে নিজের অবস্থানকে করেছেন মজবুত।
বর্তমানে তার কারখানায় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী হয়েছে একশরও বেশী শ্রমিকের। মেশিনের সংখ্যাও বেড়ে পঞ্চাশ ছাড়িয়ে এখন। প্রতিযোগীতার বাজারে নিজের সুনাম অক্ষুন্ন রেখে এগিয়ে চলেছেন। তারই হাতে তৈরী হয়েছে একই পণ্যের বেশ কিছু রপ্তাণীকারক। সেই সাথে রাষ্ট্রের উন্নয়নে সঠিক পরিমান কর পরিশোধেও সে বদ্ধ পরিকর।
তরুন উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ চাইতেই খুব সাচ্ছন্দেই বলছিলেন খন্দকার মিকি তরুনরা এখন অনেক এগিয়ে। তথ্য প্রযুক্তির যুগে মেধাভিত্তিক ব্যবসা করার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি বলেন পরিশ্রম ও ধৈয্য ধরে সততার সাথে এগিয়ে যাওয়ার কথা। তিনি আরও বলেন পড়াশুনা চাকুরির উদ্দেশ্যে না করে অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নিজে কিছু করার জন্য চেষ্টা করতে। সম্ভাবনার যে বাংলাদেশ তাতে তিনি শুধু তরুন নয় তরুনীদেরও সংযুক্ত করে বলেন নারীরাও এখন ব্যবসা করছে এবং ঘরে বাইরে কাজ করছে। সময় এসেছে নারী পুরুষ একসাথে দেশ গড়ার। তারাও প্রমান করছে ব্যবসার ক্ষেত্রে তারাও পিছিয়ে নয়।
অতিথি পরায়ন প্রেরনাদায়ক এ মানুষটি সফলতা প্রসঙ্গে বলেন, সফলতা মানেই অনেক অনেক টাকা পয়সার মালিক হওয়া নয়। সফলতা মানে সততা ও সুনামের সাথে ব্যবসা পরিচালনা করা। উদ্যোক্তার খোজে ডটকমকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন আপনাদের এ উদ্যোগ তরুনদের অনুপ্রেরণা যোগাবে। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের তথ্য বহুল অন্যতম একটি পরিবার হবে এটি।
সূত্র: উদ্যোক্তার খোজে