প্রত্যেক সফল মানুষেরই জীবনে একটি গল্প থাকে। তাকে ঐ সফলতার জন্য অনেক কষ্ট ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়েছে। পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক কন্টকাকির্ন পথ। যাদের পরিশ্রমের ফল আমরা দেখতে পাই। কিন্তু হয়তো আমরা অনেকেই তাদেরকে জানিনা। আজ তেমনি কয়েক জন সফল মানুষ সম্পর্কে জানবো। যাদেরকে বলা হয় ‘দ্য বিজনেস আইকন অব বাংলাদেশ।’
মোস্তফা কামাল: আমরা ফ্রেশ ব্রান্ডের অনেক পন্যই বাজার থেকে কিনি। কিন্তু এটা যে কার পরিশ্রমের ফসল তা আমরা অনেকেই জানিনা। আর তিনি হলেন মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল। মোস্তফা কামালের জন্ম কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামে। তিনি ছিলেন কৃষি নির্ভর অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। নিজ গ্রামের স্কুলে পাঠ চুকিয়ে গ্রাম থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরের একটি স্কুলে ভর্তি হন।
সেখানে তার যেতে হতো হেঁটে। তাই তিনি বাবার কাছে বায়না ধরেন তাকে সাইকেল কিনে দিতে হবে। বাবা অপারগতা প্রকাশ করলে রাগ করে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। সেই থেকেই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়
তিনি ঢাকায় এসে যাত্রাবাড়িতে থাকতেন। সেখানে থেকে ৭৫ টাকায় একটি চাকরি নেন। এ আয় থেকে কিছু টাকা জমাতে থাকেন। যাত্রাবাড়িতে এক কাকার সুপারির দোকানে বসতেন তিনি। আর এখান থেকে তিনি ব্যাবসার অনুপ্রেরণা পান। সেই জমানো টাকা দিয়েই তিনি ব্যাবসা শুরু করেন।
শুরুতেই ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো থেকে সুপারী, আদা, রসুন, লবনসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে এসে ব্যাবসা শুরু করেন। প্রথম দিকে ভালো ব্যাবসা করেন তিনি। এরপর কয়েকজন বন্ধু নিয়ে ব্যাবসা বড় করেন। এক পর্যায়ে ব্যাবসা বড় হলে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করা শুরু করেন। কিন্তু প্রথম ধাক্কা খান চট্টগ্রাম পোর্টে।তার কিছু পণ্য আটকে যাওয়ার প্রায় দেড় বছর পর সেগুলো ফেরত পান।
এতে তার ব্যাবসায় ধস নামে। কিন্তু তাতেও তিনি থেমে যাননি। অল্প টাকায় তিনি মেঘনা নদীর পাড়ে জমি কিনে তাতে তেলের কারখানা দেন। যাতে তিনি নিজেই তেল পেকেট জাত করে পুণরায় উঠে আসার চেষ্টা করেন। আর তিনি তাতে বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেন। পর্যায়ক্রমে তিনি প্রায় ১৫টি কোম্পানির মালিক হন।
মোস্তফা কামাল তরুনদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমরা যারা ব্যাবসা শুরু করতে চাও। তবে শুরুতেই প্রচুর পড়াশুনা কর। আর নতুন কিছু করার চেষ্টা কর।’
সবুর খান: তরুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা সবুর খান। চাঁদপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। গ্রামের স্কুলের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ১৯৯৯ সালে তিনি ব্যাবসা করার চিন্তা করেন।
ভাল ছাত্র হওয়ার সুবাদে তিনি যে শিক্ষা বৃত্তি পেতেন সেখান জমানো ২২ হাজার টাকা এবং বন্ধুদের সহযোগিতায় মোট ৫৬ হাজার টাকা নিয়ে ড্যাফোডিল নামের একটি কম্পিউটার দোকান দিয়ে বিভিন্ন অফিসের কাজ করতে শুরু করেন।
শুরুতেই ব্যাবসা নতুন হওয়াতে তাকে অনেক প্রতিকুলতার সম্মুখিন হতে হয়। মেধাও যোগ্যতার মধ্য দিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই প্রতিকুলতা কাটিয়ে উঠতে পারেন তিনি। একপর্যয়ে তিনি তার দোকানে কম্পিউটারের পার্টস বিক্রি শুরু করেন। এরপর তাকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি।
এরপর তিনি তার প্রতিষ্ঠানকে ড্যাফোডিল গ্রুপে পরিণত করেন। এখন ড্যাফোডিল গ্রুপে আছে শিক্ষাকার্যক্রম, টেকনোলোজিসহ আরো অনেক কিছু। তিনি তরুন সমাজের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা বাস্তবমুখি হোন। নতুন কিছু করার চিন্তা করুন।’
আব্দুস সালাম: ওয়েল গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের জন্ম চট্টগ্রামের এক সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তিনি মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ভর্তি হয়ে জাইগির থেকে পড়াশুনা করেন। জাইগির মালিক তাকে কলেজে যাবার সময় প্রতিদিন ৫০ পয়সা করে দিতেন।
সেখান থেকে পয়সা বাচিয়ে এবং প্রাইভেট পড়িয়ে কিছু টাকা জমা করেন। সেই জমানো টাকা এক শিক্ষককে দেন। শিক্ষকের পরামর্শে তিনি প্রথমে কর্ণফুলি পেপার মিল থেকে কিছু টাকার কাগজ কিনে বাজারে বিক্রি করে বেশ মুনাফা পান। তারপর থেকে একে একে তিনি উপর দিকে উঠতে থাকেন।
১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামে একটি রুম ভাড়া নেন। সেখানে একটি সেলাই মেশিন বসিয়ে নিজেই কাপড় সেলাই করে বাজারে বিক্রি করে পুজি ভারি করেন। এভাবে ব্যাবসা বড় করে তোলেন। এখন তিনি ওয়েল গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি যুব সমাজের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমরা একটি লক্ষ নিয়ে দৃঢ় ভাবে দাড়িয়ে থাক ফল পাবে।’
ডা: এ এম শামিম: ডা: এএম শামিম ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র। বাবা ছিলেন সরকারী চাকুরিজীবী। ১৯৮৫ সালে পড়াশুনা অবস্থায় ৩ বন্ধু একত্রে গ্রিন ‘ডায়াগনোষ্টিক’ নামের একটি ডায়াগনোষ্টিক সেন্টার দেন। যা তৎকালিন সময়ে প্রথম প্রাইভেট ডায়াগনোষ্টিক। কিন্তু সেই টাকা ছিলো বাবার অবসর ভাতা থেকে নেওয়া ৫৫ হাজার টাকা।
পরিবারের সবাই মনে করেছিল সে মেধাবী ছেলে, অবশ্যই সরকারী চাকুরি করবে। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন নিজেই কিছু করবো। আর তাতেই হয়ে গেল। কিন্তু তিনি ভেবে ছিলেন সেটা এমন কিছু হবে যা অন্য কেউ করেনি বা একটু ব্যতিক্রম।
তাইতো তার মাথায় এসেছিলো ডায়াগনোষ্টিক সেন্টার দেয়ার পরিকল্পনা। তারপর এসেছিলো মেডিকেল টেকনলোজি কলেজের। তিনিই প্রথম ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে মেডিকেল টেকনলোজি শিক্ষা ব্যাবস্থা চালু করেন। এভাবে নতুন নতুন ধারণা নিয়ে এগোতে থাকেন তিনি।
আজ তার ল্যাবএইড গ্রুপের অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মেডিকেল সার্ভিস থেকে শুরু করে শিক্ষা ব্যাবস্থায় তার অনেক সফলতা রয়েছে।
তিনি তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমাদের অনেক পরিশ্রম করতে হবে। নতুন নতুন ধরণা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আর চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে।’
জয়নাল আবেদীন: এক সময় মাত্র একটি ট্রাক ছিল তার। এখন তিনি একে একে ১২শ’ বাসের মালিক। দেশের বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি করে চলেছে তার বাসগুলো। এলাকায় তিনি ‘ফাদার অব ট্রান্সপোর্টেশন’ হিসেবেই পরিচিত। সংগ্রামী ও সফল এই মানুষটির নাম জয়নাল আবেদীন। হানিফ এন্টারপ্রাইজের স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি।
জীবনের শুরুটা বেশ বন্ধুর ছিল তার। আর নিরলস শ্রম ও কঠোর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে এ সুযোগটা কাজে লাগাতে সক্ষম হন তিনি। তার হাত ধরেই বিকশিত হয়েছে দেশের পরিবহণ খাত। গণপরিবহণে তার ভূমিকা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে সবাই। এলাকার মানুষ তাকে ডাকেন জয়না মহাজন নামে।
জয়নাল আবেদীনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার সাভারে। মাত্র একটি ট্রাক নিয়ে পথ চলা শুরু। পরবর্তীতে শুরু কোচ ব্যবসা। গড়ে তোলেন পরিবহন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘হানিফ এন্টারপ্রাইজ’। ছোট ছেলে হানিফের নামেই গড়ে তুলেছিলেন হানিফ এন্টারপ্রাইজ। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
পেট্রোল পাম্প, সিএনজি স্টেশন, ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচারিং, কোল্ডস্টোরেজ, পানীয় ও প্রকাশনা ব্যবসাও গড়ে তুলেছেন এ স্বপ্নবাজ মানুষ। পরবর্তীতে যেখানেই হাত দিয়েছেন সোনা ফলিয়েছেন সেখানেই। বড় ছেলে আলহাজ্ব কফিল উদ্দিন রাজনীতিবিদ। সাভার উপজেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানা প্রতিবন্ধকতার বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়েছেন সাভার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে। তবে রাজনীতি সম্পর্কে তীব্র অনীহা জয়নাল আবেদীনের। বাবা হাজী মো. আজিম উদ্দিন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টানা দুই যুগ আমিনবাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
কিন্তু রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে উঠলেও প্রথম থেকেই রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে চলেছেন জয়নাল আবেদীন। মিডিয়া তাকে আকর্ষণ করে না। সবাই দুই ছেলেকে চিনলেও হানিফ এন্টারপ্রাইজের আসল কারিগর জয়নাল আবেদীন সবসময়ই গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলেছেন। তাই তাকে নিয়ে কৌতুহলের শেষ নেই সাধারণ মানুষের।
জয়নাল আবেদীন বলেন, আমার জন্ম সাভার আমিনবাজারের হিজলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম ব্যবসায়ী পরিবারে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে আমি ছিলাম পঞ্চম। বাবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকার সময় আমদানি রফতানির ব্যবসা করতেন।
বিশেষ করে তিনি ধান-চাল ও চামড়ার সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। আমার বাবাই ছিলেন প্রথম ব্যবসায়ী যিনি সে সময় প্রথম করাচী, বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) ও বার্মার (বর্তমানে মায়ানমার) সঙ্গে জলপথে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন। সে সুবাদে সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদ আসতেন আমাদের বাড়িতে। সে সময় আমার বড় ভাই সালাউদ্দিন ডাক্তারি পড়ছিলেন।
আমি তখন ভর্তি হই আমিনবাজার মিরপুর মফিদ-ই-আম জুনিয়র মাদ্রাসায়। সেখান থেকে বাবা আমাকে ভর্তি করেন মিরপুর সিদ্ধান্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে। সে সময় আমি অত্যন্ত দূরন্ত ছিলাম। লেখাপড়ায় মন ছিল না। সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরতাম।
এরই মধ্যে বাবা বড় ভাইয়কে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। মিরপুরের হাজী নুরুল ইসলামের মেয়ে মমতাজ বেগমের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করলেন। কিন্তু বড় ভাই তখন বিয়েতে রাজি ছিলেন না। তাই আমাকেই বসানো হলো সেই বিয়ের পিঁড়িতে। তখন আমার বয়স মাত্র ১৪ বছর। আর মমতাজ বেগমের বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর।
পড়াশোনায় মনোযোগী না হওয়ায় ব্যবসা শুরু করলাম। বাবার টাকায় শুরু করলাম ধান-চালের ব্যবসা। সে সময় এতো পরিবহন তো ছিলই না, এমনকি দূরপাল্লার রাস্তাও ছিল কম। যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল ট্রেন, না হয় নৌপথ। ধান-চালের ব্যবসায় কমলাপুর থেকে ট্রেনে সান্তাহার-সেখান থেকে বাসে চেপে নওগাঁ-তারপর টমটম ধরে মহাদেবপুর-সেখান থেকে পায়ে হেটেঁ চলে যেতাম মহিষবাথান নামের জায়গায়।
সেখানের মানুষ আমার কাছে তিন হাজার টাকা দেখে অবাক! তারা ভাবছিল এত কম বয়সী ছেলের হাতে এত টাকা! এমনকি আমাকে চাল ব্যবসায়ী মনে করাটাও বোকামি মনে করছিল অনেকে। হঠাৎ পূর্ব পাকিস্তানে চালে আকাল। চালের সরবরাহ কম, মূল্য বেশী। তাই চাল কিনতে প্লেনে চেপে যশোর গেলাম।
ভাড়া ছিলো মাত্র ২৭ টাকা। সাথে ছিল আমার গোমস্তা। সে সময়ই আমি একাই আড়াইশ মণ চাল কিনলাম। এবার ফেরার পালা। নানা ঘাট হয়ে আমাদের চাল বোঝাই নৌকা যখন মুন্সীগঞ্জের কাছে পদ্মায় ভাসছিল তখন প্রচণ্ড ঝড়ে নৌকা ডুবে গেল। সে যাত্রায় মাঝিদের সহায়তায় প্রাণে রক্ষা পাই।
যতদূর মনে পড়ে, ওই দুর্ঘটনায় হাতের মুঠোয় আকঁড়ে রাখা ৫০ টাকা ছিল বাড়ি ফেরার শেষ সম্বল। বাড়ি ফিরে ধান-চালের ব্যবসা বাদ দিলাম। এরপর পরিবারের ৫ ভাই একসঙ্গে হজ্ব করতে সৌদি আরবে গেলাম। এ ঘটনা এলাকায় তো বটেই, ভরতবর্ষেও তোলপাড় তুলে দিলো। তৎকালীন লর্ড এই উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করে আমাদের পরিবারকে ঐতিহ্যবাহী পরিবার আখ্যা দেন।
এলাকায় আমাদের বাড়ির নাম হলো হাজী বাড়ি। আমরা কলকাতা বন্দর থেকে জলপথে জাহাজে চেপে সৌদি বন্দরে পৌঁছালাম। সেখান থেকে উটের পিঠে চড়ে গেলাম মক্কা-মদিনায়। স্বাধীন হওয়ার পর দেশ পুনর্গঠনে ডাক পড়লো। মানিক মিয়া এভিনিউ, সংসদ ভবন এলাকায় তখন বোরো ক্ষেত। ওই ক্ষেতে সাব কন্ট্রাক্টে শুরু করলাম মাটি ফেলার কাজ।
মাত্র ১৪ হাজার টাকায় তিন টনি একটি পেট্রোল ট্রাক কিনলাম। সেখান থেকেই শুরু। সঙ্গে কয়েকটি ট্রাক ভাড়াও নিলাম। পরে ট্রাকটি বিক্রি করে বেডফোর্ডের পাঁচ টনি ডিজেল ট্রাক কিনলাম। একই সময় কাজ পেলাম ফেনীর মাতা মুহুরী নদীর বাঁধ নির্মাণে। সেখানেও সাব কন্ট্রাক্ট।
মাটি ফেলার জন্যে ঠিকাদার আমাকে অগ্রীম ১০ লাখ টাকা দিলেন। তা দিয়ে কিনলাম দুটি হিনো কোচ। ছোট ছেলে হানিফের নামে যাত্রা শুরু করলো ‘হানিফ এন্টাপ্রাইজ’। প্রথমে ঢাকা-বগুড়া রুটে। পরবর্তীতে একটির সাফল্য ধরে আরো একটি একটি করে রুট বাড়তে থাকলো। এভাবেই গত চার দশকে বহরে যুক্ত হয়েছে ১২শ’ বাস।
রাজনীতিতে না আসার কারণ জানতে চাইলে জয়নাল আবেদীন বলেন, হয়তো আরও বহুদূর যেতাম! তারপর নিজের আবেগ থামিয়ে সতর্ক হয়ে কথায় ফিরিয়ে আনেন নিজেকে। বর্তমানে হানিফ এন্টারপ্রাইজে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। সততা, বিশ্বস্ততা আর নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন জয়নাল আবেদীন। আজ অনেকেই তার দুই ছেলেকে চেনেন। আর এখানেই তার আনন্দ।
আকিজ উদ্দীন: খুলনার ফুলতলা থানার মধ্যডাঙ্গা গ্রামে ১৯২৯ সালে জন্ম নেন শেখ আকিজ উদ্দীন। শৈশব কেটেছে কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে। স্বপ্ন দেখতেন দারিদ্র জয় করে একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেন। কিন্তু জীবন সংগ্রামের শুরুতে পদে পদে বাধার মুখে পড়েন। সেই বাধা পেরোতে শেখ আকিজ উদ্দীনের সম্বল ছিল সাহস, সততা আর কঠোর পরিশ্রম। এই তিনটি জিনিসকে পুঁজি করেই শুরু হয় উদ্যোক্তা আকিজ উদ্দীনের উত্থান পর্ব।
মাত্র ১৬ টাকা পুঁজি নিয়ে ১৩ বছর বয়সে গলায় ঝুড়ি ঝুলিয়ে কমলালেবুর ফেরিওয়ালা হিসেবে ব্যবসা শুরু করেন। এরপর ১৯৫২ সালে বিড়ির ব্যবসার মধ্য দিয়ে আকিজ উদ্দীনের ব্যবসার গতি-প্রকৃতি একেবারে জাদুর মতো বদলে যেতে থাকে। পরবর্তী সময়ে তিনি যে ব্যবসায় হাত দিয়েছেন, সেখানেই সাফল্য পেয়েছেন।
একে একে তিনি দেশের উল্লেখযোগ্য ২৩টি শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করে ব্যবসার জাদুকরে পরিণত হন। আকিজ গ্রুপ ও আদ্-দ্বীনের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আকিজ উদ্দীন জীবন থেকে পাঠ নিয়ে দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে লাখো মানুষের নিয়োগকর্তা হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখান।
ব্যবসার শুরুতে তিনি যেভাবে বাধার মুখে পড়েন, আকিজ উদ্দীনের বাবা শেখ মফিজ উদ্দিন ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসয়ী। তিনি খুলনার ফুলতলা থানার মধ্যডাঙ্গা গ্রামে ফল ও ফসলের মৌসুমি ব্যবসা করতেন। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মা-বাবার একমাত্র সন্তান হয়েও আকিজ লেখাপড়া করার সুযোগ পাননি। তিনি খুব কাছ থেকে দারিদ্র্য দেখেছেন।
আর গভীরভাবে বাবার ব্যবসা পর্যবেক্ষণ করেছেন। স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু স্বপ্নের কোনো কিনারা করতে না পেরে ১৯৪২ সালে মাত্র ১৬ টাকা হাতে নিয়ে জীবিকার সন্ধানে কিশোর শেখ আকিজ উদ্দিন খুলনার মধ্যডাঙ্গা গ্রাম থেকে বের হন। ট্রেনে চেপে তিনি কলকাতায় যান। কলকাতার শিয়ালদহ রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তিনি রাত কাটাতেন।
ওখানেই পাইকারি বাজার থেকে কমলালেবু কিনে ফেরি করে বিক্রি করেছেন। কিছু দিন কমলালেবুর ব্যবসা করার পর তিনি একটি ভ্রাম্যমাণ দোকান দেন। কিন্তু একদিন পুলিশ অবৈধভাবে দোকান দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। কয়েক দিন জেল খেটে মুক্ত হয়ে আকিজ উদ্দিন উদ্ভ্রান্তের মতো কলকাতা শহর ঘুরেছেন।
কলকাতায় তাঁর সঙ্গে পাকিস্তানের পেশোয়ারের এক ফল ব্যবসায়ীর পরিচয় হয়। আকিজ ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে পেশোয়ারে গিয়ে ফলের ব্যবসা শুরু করেন। দুই বছর ব্যবসা করে তাঁর পুঁজি দাঁড়ায় ১০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আকিজ বাড়ি ফিরে আসেন। যেভাবে উত্থান আকিজের, ১৯৫২ সালের দিকে বন্ধুর বাবা বিড়ি ব্যবসায়ী বিধু ভূষণের সহযোগিতায় আকিজ উদ্দিন বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন।
পাশাপাশি তিনি গ্রামগঞ্জ ঘুরে ধান, পাট, নারকিল ও সুপারি কিনে আড়তে আড়তে বিক্রি করেছেন। সামান্য কিছু টাকা জমিয়ে বাড়ির পাশে বেজেরডাঙ্গা রেলস্টেশনের কাছে একটি দোকান দেন। কিন্তু দোকানটি আগুনে পুড়ে যায়। আকিজ সর্বশান্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি এলাকাবাসীর সহায়তায় ফের দোকান দেন।
পাশাপাশি শুরু করেন ধান, পাট, চাল ও ডালের ব্যবসা। এরপর তিনি সুপারির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। রাত জেগে সেই সুপারি ছিলে দিতেন তাঁর সহধর্মিণী। এই সুপারি তিনি কলকাতায় পাঠাতেন। সুপারির ব্যবসায় তাঁর বেশ লাভ হয়। এরপর তিনি বিধু বিড়ির মালিক বিধু ভূষণের পরামর্শে বিড়ির ব্যবসায় যুক্ত হন।
নাভারণের নামকরা ব্যবসায়ী মুজাহার বিশ্বাসের সহায়তায় তিনি ছোট্ট একটি বিড়ি তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন। শুরু হয় আকিজের উত্থান পর্ব। বিড়ি ফ্যাক্টরির পর ১৯৬০ সালে অভয়নগরে অত্যাধুনিক চামড়ার কারখানা এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ, ১৯৬৬ সালে ঢাকা টোব্যাকো, ১৯৭৪ সালে আকিজ প্রিন্টিং, ১৯৮০ সালে আকিজ ট্রান্সপোর্ট, নাভারণ প্রিন্টিং,
১৯৮৬ সালে জেস ফার্মাসিউটিক্যাল, ১৯৯২ সালে আকিজ ম্যাচ, ১৯৯৪ সালে আকিজ জুট মিল, ১৯৯৫ সালে আকিজ সিমেন্ট, আকিজ টেক্সটাইল, ১৯৯৬ সালে আকিজ পার্টিকেল, ১৯৯৭ সালে আকিজ হাউজিং, ১৯৯৮ সালে সাভার ইন্ডাস্ট্রিজ, ২০০০ সালে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ,
একই বছর আকিজ অনলাইন, নেবুলা ইন্ক, ২০০১ সালে আকিজ করপোরেশন, আকিজ কম্পিউটার, আকিজ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড টেকনোলজি, ২০০৪ সালে আফিল এগ্রো, ২০০৫ সালে আফিল পেপার মিলস প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শেখ আকিজ উদ্দিন অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
এ ছাড়া তিনি আদ্-দ্বীন ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করে স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর মৃত্যুর পর সন্তানরা আরো অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। আকিজ উদ্দিনের ছেলে স্মৃতিচারণা করে ডাক্তার শেখ মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমার বাবা আমাদের বলতেন, আগুন হয়তো মনের শক্তি দিয়ে হাতে চেপে রাখা যায়। কিন্তু ক্ষমতা ও সম্পদ ধরে রাখা তার চেয়ে আরো অনেক কঠিন।
বাবার এই বাণী ধারণ করে তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি সমাজসেবার হাল ধরে রেখেছি।’ অপর ছেলে শেখ বশির উদ্দিন বলেন, ‘বাবার নামাজ-কালামের পরই ছিল ফিন্যানশিয়াল ডিসিপ্লিনের স্থান। এ ছাড়া তাঁর সময়জ্ঞান ছিল উল্লেখ করার মতো। তিনি কোনো মিটিংয়ে এক মিনিট পরে আসেননি। আমি তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুটি অনুসরণ করে লাভবান হয়েছি।’ তথ্যসূত্র: উদ্যোক্তার খোঁজে