ক্রিকেট মাঠে অধিনায়কত্ব করাটা কতটা কঠিন তা সবথেকে ভাল জানে ইতিহাস। কালের খ্যাতিনামা ক্রিকেটার, অথচ অধিনায়কের ভার চাপতেই ভেঙে পরা! ওয়ানডে ক্রিকেটের ৪৮ বছরের ইতিহাসে ক্রিকেটবিশ্ব দেখেছে অনেক খ্যাতনামা অধিনায়কদের। যাঁদের অধিনায়কত্বে সাধারণ দলও হয়ে উঠেছিল অসামান্য। ওয়ানডে ক্রিকেটের এমন সেরা ১১ অধিনায়ক নিয়েই আজকের প্রতিবেদন।স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যান, স্যার ফ্রাঙ্ক ওয়েরেল থেকে হালের মাশরাফি কিংবা কেন উইলিয়ামসন- সবার নাম এই তালিকায় স্থান না পেলেও তাঁদের বীরত্বগাথা অধিনায়কত্বটাও কম নয়। জয়-হারের ভিত্তিতে করা সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের নিয়ে গড়া একাদশ-
১. সৌরভ গাঙ্গুলী-ঃ এই তালিকায় শীর্ষেই রয়েছেন ভারতীয় কিংবদন্তি ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলি। তার নেতৃত্বাধীন দল বিশ্বাস করত যে কোনও দেশের মাঠে যে কোনো প্রতিপক্ষের বিপক্ষে জিততে পারে। তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং অতুলনীয় আগ্রাসনের কারণে তিনি অনন্য হয়ে আছেন।
ওয়ানডে ক্রিকেটে তার নেতৃত্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৪৬ ম্যাচের মধ্যে ৭৬টিতে জয় পায় ভারত। তার অধিনায়কত্বে প্রত্যাশার চেয়েও ভালো খেলেছেন যুবরাজ সিং, মহেন্দ্র সিং ধোনি, মোহাম্মদ কাইফ, ইরফান পাঠানরা। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালেও তিনি ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
অধিনায়কের রেকর্ডের পাশাপাশি সৌরভ গাঙ্গুলী শচীনের সঙ্গে জুটি বেঁধে ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বকালের অন্যতম দুর্দান্ত ওপেনিং জুটি তৈরি করেছিলেন। ব্যাট হাতে ৩০৮ ম্যাচ খেলে ভারতের হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ ১১ হাজার ২২১ রান করেন গাঙ্গুলী।
২. গ্রায়েম স্মিথ-ঃ দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম সফল অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে স্মিথ সবচেয়ে সফল অধিনায়ক। ওয়ানডে ক্রিকেটেও তার দুর্দান্ত রেকর্ড রয়েছে। তিনি প্রোটিয়া অধিনায়ক হিসেবে ১৫০ টি ম্যাচের মধ্যে ৯২টি জয় উপহার দেন। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সর্বোচ্চ ১৪৯ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে ৯২টিতে জয় উপহার দেন স্মিথ।
ওয়ানডেতে ক্রিকেটে ওপেনার হিসাবে গ্রায়েম স্মিথ আফ্রিকার হয়ে পঞ্চম সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৯৮৯ রান সংগ্রহ করেন। ২০০৭ ও ২০১১ বিশ্বকাপে প্রোটিয়া দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। দ্বিপাক্ষিক সিরিজে স্মিথের নেতৃত্বাধীন দলের বিপক্ষে খেলতে প্রতিপক্ষ দল আতঙ্কিত থাকত।
৩. রিকি পন্টিং-ঃ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক রিকি পন্টিং। ১৯৯৫ সালে তাসমানিয়ায় ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান এ কিংবদন্তির। ২০১২ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি।
ওয়ানডেতে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩০টি সেঞ্চুরির পাশাপাশি তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৭০৪ রান সংগ্রহ করেন। ২০০০ থেকে ২০০০৭ সাল পর্যন্ত পন্টিংয়ের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলকে সর্বকালের সেরা ওয়ানডে দলে পরিণত করেছিলেন।
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ ২২৯ ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়ে ১৬৪ ম্যাচে জয় উপহার দেন তিনি। ইতিহাসে পন্টিং একমাত্র অধিনায়ক যিনি আইসিসির চারটি ট্রফি জয়ে নেতৃত্ব দেন।
৪. ব্রায়েন লারা-ঃ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তি ব্রায়েন লারা। তাকে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি যিনি এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ৪০০ রান করেছেন। উইন্ডিজের হয়ে ১৩০ টেস্টে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৯১২ রান করেছেন।
অধিনায়ক হিসেবে লারা উইন্ডিজের হয়ে সর্বোচ্চ ১২৫ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে ৫৯ খেলায় জয় উপহার দেন। তিনি ১৯৯৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ক্যারিবীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে দলকে সেমিফাইনালে উঠতে সহায়তা করেন তিনি। ওয়ানডে ক্রিকেটে উইন্ডিজের হয়ে ২৫টি সেঞ্চুরির সাহায্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৩৪৮ রান করেন লারা।
৫. স্টিভ ওয়াহ-ঃ ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে মার্ক টেলরের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হেরে গেলে নেতৃত্ব চলে আসে স্টিভ ওয়াহর কাঁধে। আক্রমণাত্মক অলরাউন্ডার হিসেবে তিনি বেশ পরিচিতি ছিলেন। অধিনায়ক হিসেবে তিনি বিশ্বের নজর কাড়তে না পারলেও অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে স্টিভ ওয়াহ ৩২৫ ওয়ানডেতে ৭ হাজার ৫৬৯ রান করেছিলেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ ১০৬ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে ৬৭টি জয় উপহার দেন তিনি।
৬. মহেন্দ্র সিং ধোনি-ঃ ভারতীয় ক্রিকেট দলের অন্যতম সেরা অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। ওয়ানডে ক্রিকেটে তিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ও ২০১৫ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতে নেয় ভারত। ভারতীয় অধিনায়ক হিসাবে সর্বোচ্চ ২০০ ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়ে সবচেয়ে বেশি ১১০ ম্যাচে জয় উপহার দেন ধোনি। শুধু অধিনায়ক হিসেবেই নন, ধোনি ভারতীয় পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৩৪৭ মাচে ১০ হাজার ৫৯৯ রান সংগ্রহ করেন।
৭. কপিল দেব-ঃ ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ী দলের অধিনায়ক তিনি। কপিল দেবের নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয় পায় ভারত। তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম কিংবদন্তি। পেস বোলার হিসেবে ২২৫ ম্যাচ খেলে ২৫৩ উইকেট শিকার করেন কপিল দেব। আর ব্যাটসম্যান হিসেবে সংগ্রহ করে ৩ হাজার ৭৮৩ রান সংগ্রহ করেন। তার নেতৃত্বে ৭৪ ম্যাচের মধ্যে ৩৯টি জয় পায় ভারত।
৮. ইমরান খান-ঃপাকিস্তানের জীবন্ত কিংবদন্তি ইমরান খান। তার নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ জিতে নেয় পাকিস্তান। বিশ্বকাপের পরে ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত দলটির অধিনায়ক ছিলেন। ক্রিকেট থেকে অবসরে রাজনীতিতে জড়িয়ে যান ইমরান খান।
বর্তমানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী এই তারকা ক্রিকেটার। পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ ১৩৯ ওয়ানডে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে ৭৫টি ম্যাচে জয় উপহার দেন তিনি। পেসার হিসেবে ১৭৫ ম্যাচ খেলে ১৮২ উইকেট শিকারের পাশাপাশি ব্যাট হাতে সংগ্রহ করেন ৩ হাজার ৭০৯ রান।
৯. ওয়াসিম আকরাম-ঃ ইমরান খানের অবসরের পর পাকিস্তানের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন ওয়াসিম আকরাম। তার নেতৃত্বে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলে পাকিস্তান। ইমরান খানের পর পাকিস্তানের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০৯ ম্যাচে নেতৃত্ব দেন তিনি। ওয়াসিম খানের নেতৃত্বে ৬৬টি ওয়নাডেতে জয় পায় পাকিস্তান। ৩৫৬ ম্যাচ খেলে পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ ৫০২ উইকেট শিকার করেন এ পেসার। মুত্তিয়া মুরালিধরন তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ওয়ানডে ক্রিকেটে ওয়াসিম আকরামই সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ছিলেন।
১০. ড্যানিয়েল ভেট্টরি-ঃ স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের পর নিউজিল্যান্ডের অধিনায়কের দায়িত্ব চলে আসে ড্যানিয়েল ভেট্টরির কাঁধে। বাঁ-হাতি এ স্পিনার নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। অধিনায়ক হিসাবে ৮২ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে ৪১ ম্যাচে জয় উপহার দেন তিনি। কিউইদের হয়ে ২৯১টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে সর্বোচ্চ ২৯৭ উইকেট শিকার করেন ভেট্টরি।
১১. শন পলক-ঃ ম্যাচ পাতানোর অভিযোগে যখন লণ্ডভণ্ড দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট, তখন নিজের কাঁধে অধিনায়কত্ব চাপান এই বোলার। গতি ছাড়াও যে ব্যাটসম্যানকে পরাজিত করা যায় তাঁর আদর্শ উদাহরণ বয়ে এনেছিলেন পলক। পাঁচ বছরের অধিনায়কত্বে প্রোটিয়াদের দিয়েছেন অনেক সুখস্মৃতি।
দক্ষিণ আফ্রিকাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৯৭ ম্যাচে। স্মিথের কাছে অধিনায়কত্ব হস্তান্তর করার পূর্বে ৯৭ ওডিআইয়ের ভেতর ৬০ টিতেই জয় পেয়েছে প্রোটিয়ারা। জয়ের হার ৬৪.০৬ শতাংশ। নেতৃত্বের পাশাপাশি বল হাতেও অনবদ্য শন পলক ওয়ানডে ক্রিকেটে নিয়েছেন ৩৯৩ উইকেট