অনিশ্চয়তার মধ্যেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য সব রকমের প্রস্তুতি নিয়েছিলো বাংলাদেশ। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ‘যারা যেতে চাইবে’ তাদের পরিবহনের জন্য যানবাহনও প্রস্তুত রাখা হয়েছিলো। প্রত্যাবাসনকে ঘিরে টেকনাফের নয়াপাড়া থেকে দক্ষিণের শালবাগান এবং জাদিমুরা এলাকা থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ঘুমধুম পর্যন্ত নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এতো প্রস্তুতির পরও শেষ পর্যন্ত ঘোষণা এলো, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হয়নি।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম আজাদ বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, আজ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হচ্ছে না। কোনো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্যে আসেননি। যারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হবেন শুধু তাদেরকেই ফেরত পাঠানো হবে। জোর করে কাউকে পাঠানো হবে না।
প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাক্ষাৎকার ও মতামত গ্রহণ অব্যাহত রেখেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দেখতে ঢাকায় মিয়ানমার ও চীন দূতাবাসের কর্মকর্তারা কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ভারতও।
এবারও প্রত্যাবাসনের উদ্যোগের সফলতা নিয়ে সংশয় ছিলো শুরু থেকেই। প্রত্যাবাসন বিরোধী চক্রের অপতৎপরতার কারণে এবারও শেষ মুহুর্তে এসে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হলো। মিয়ানমারের আন্তরিক সদিচ্ছার অভাব এবং কিছু বিদেশি এনজিওর প্রত্যাবাসন বিরোধী তৎপরতার কারণে গত বছরের ১৫ নভেম্বর প্রথম দফায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ ভেস্তে গিয়েছিলো বলে অভিযোগ রয়েছে। এবারও কিছু রোহিঙ্গা মিয়ানমারের ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে নানা শর্তের কথা বলছে। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে সরাসরি নাগরিকত্ব প্রদান, ভিটে-বাড়ি ও জমি-জমা ফেরত, আকিয়াব জেলায় আশ্রয় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের নিজ বাড়ীতে ফেরত, কারাগারে বন্ধি রোহিঙ্গাদের মুক্তি, হত্যা, ধর্ষনের বিচার, অবাধ চলাফেরা, নিরাপত্তা প্রদান।
প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গার মধ্যে গত মঙ্গলবার ও বুধবার দুই দিনে ২৩৫ রোহিঙ্গা পরিবারের মত যাচাই করেছে জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এবং শরনার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার ২১ পরিবারের এবং গতকাল বুধবার ২১৪ পরিবারের মত যাচাই করা হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শরনার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবসন কমিশনার মো. আবুল কালাম।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য নির্ধারিত দুই জায়গা টেকনাফের নাফনদী সংলগ্ন কেরুনতলী ঘাট ও ঘুমধুম সীমান্তের ট্রানজিট ক্যাম্প ঘুরে ব্যাপক প্রস্তুতি চোখে পড়ে। কেরুনতলীতে ট্রানজিট ক্যাম্পে ১১টি টিন শেড ব্যারাক রয়েছে। ওইসব ব্যারাকের প্রত্যেকটিতে তিনটি করে মোট ৩৩টি ঘর নির্মাণ করা আছে। অপরদিকে উখিয়ার কুতুপালং টিভি রিলে কেন্দ্রের বিপরীতে ঘুমধুমে নির্মিত অপর ট্রানজিট ক্যাম্পও প্রস্তুত করা হয়েছে।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ‘যারা যেতে চাইবে’ তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম।
তিনি বলেন, আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি। আমাদের যে যানবাহন দরকার, অন্যান্য যে লজিস্টিক্যাল এবং স্ট্রাকচারাল যে সমস্ত প্রস্তুতি থাকা দরকার-এগুলো সম্পূর্ণ আমাদের প্রস্তুত আছে। আগামীকাল যারাই যেতে চাইবে, যাওয়ার জন্য যারা প্রস্তুত থাকবে-তাদের সকলকে পরিবহনের জন্য আমরা প্রস্তুত আছি। তাদের (রোহিঙ্গা) জন্য আমরা ৫টি বাসের ব্যবস্থা করেছি, ৩টি ট্রাকের ব্যবস্থা করেছি। তাদের সাথে যে মালামাল থাকবে সেগুলো যদি বাসের মধ্যে সংকুলান করা না যায়; তাহলে ট্রাকের মাধ্যমে আমরা সহায়তা দেবো। আমরা টেকনাফের নয়াপাড়া থেকে দক্ষিনের শালবাগান এবং জাদিমুরা এলাকা থেকে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম পর্যন্ত আমরা নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি।
প্রসঙ্গত, জাতিগত নিধন ও গণহত্যার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়। একই বছরের ৬ জুন নেপিদোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যেও সমঝোতা চুক্তি হয়।