নাগরিকপঞ্জীর নবায়ন সম্পূর্ণ হলো। সংযোজন-বিয়োজনের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। যাঁরা আবেদন করেছিলেন তাদের মধ্যে ৩১,১২১,০০৪ (৩.১১ কোটি) তালিকাভুক্ত হয়েছে, বাদ পড়েছে ১৯,০৬,৬৫৭ (১৯.০৬ লক্ষ)। সংযাজন আর বিয়োজন তালিকার অঙ্ক যোগ করলে দাঁড়ায় ৩৩,০২৭,৬৬১ (৩.৩ কোটি) অর্থাৎ মোট আবেদনকারী। চূড়ান্ত খসড়া তালিকাচ্যুত নাম আর পরবর্তীতে নাম কর্তন তালিকার অঙ্ক দাঁড়িয়েছিল একচল্লিশ লক্ষের কিছু বেশি। প্রশ্ন হল সেই একচল্লিশ লক্ষের মধ্যে কতজনের নাম তালিকায় উঠেছে আর কতজনের নাম পরবর্তী পর্যায়ে তৃতীয় ব্যক্তির তোলা আপত্তি গ্রাহ্য হওয়ায় বাদ পড়লো, এনআরসি কর্তৃপক্ষ এবং সুপ্রিম কোর্ট ছাড়া কারও কাছে সে তালিকা নেই। বাদ পড়েছে সর্বমোট উনিশ লক্ষ, এটাই জ্ঞাত। এবার ট্রাইব্যুনাল নির্ধারণ করবে তাঁরা বিদেশি কি না।
উনিশ লাখের একটা ব্রেকআপ সর্বত্র চলছে। এবং সেটা প্রায় সবাই মেনেও নিচ্ছে। বারো লক্ষ বাঙালি হিন্দু, পাঁচ লক্ষ মুসলমান, আর দু লক্ষ অসমীয়া ভূমিপুত্র।
প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, এনআরসি-তে ধর্ম বা ভাষার কোনও কলাম ছিল না। তবে সঠিক সংখ্যাটি জানা যাচ্ছে কী করে? একটা উত্তর হতে পারে নাম দেখে হিসেব করা হয়েছে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। প্রচুর বাঙালি হিন্দু ও অসমীয়া হিন্দুর পদবী এক। যেমন ভট্টাচার্য, চক্রবর্তী, দত্ত, দাস, বরুয়া, শর্মা, গোস্বামী ইত্যাদি। মুসলিম পদবী এমনিতেই কমন। ফলে, লস্কর, চৌধুরী, আলী, আহমেদ ইত্যাদিরা অসমীয়া না বাঙালি মুসলিম বোঝার উপায় নেই। কিছু ক্ষেত্রে বাঙালি ও অসমীয়া পদবী আলাদা, তাদের না হয় চিহ্নিত করা গেল। কিন্তু ১৯ লক্ষ নাম? কখন ঝাড়াই বাছাই হলো, এবং কোন এজেন্সি করল?
এই পঞ্জীর সবচাইতে বড় ত্রুটি, যাঁরা প্রমাণপত্রের অভাবে আবেদনই করতে পারেন নি, তাঁদের হিসেবের বাইরে রাখা হয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে ৩১শে মার্চ ২০১৯ এর মধ্যে আসামের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল ১,১৭,১৬৪ জনকে বিদেশি হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। এর মধ্যে ৬৩,৯৫৯ জনকে এক্স-পার্টি অর্থাৎ একপাক্ষিক ভাবে বিদেশি ঘোষণা করা হয়েছে, কোনও শুনানিই হয়নি। শোনা যায় এঁদের মধ্যে বিরাট অংশ মুসলমান। এখন, ঘোষিত বিদেশির লিগ্যাসিনির্ভর, ভাইবোন, পুত্র-কন্যা, নাতি-নাতনিদের মতো বহু মানুষকে এনআরসির জন্য আবেদনই করতে দেওয়া হয়নি। সুতরাং, যদি ঘোষিত বিদেশি প্রতি ৫ জনকে বাদ দেওয়া হয়, তবে এটি নিজেই প্রায় ৫,৮৫,৮২০ জন মানুষ।
এ তো গেল ঘোষিত বিদেশির বিষয়। ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল গুলিতে “সন্দেহভাজন বিদেশি” হিসাবে অনির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তি রয়েছেন। এটি ঘোষিত বিদেশি ব্যক্তির সংখ্যার চেয়ে বেশি হতে পারে। এই ধরনের মামলার একটি বিশাল ব্যাকলগ রয়েছে কারণ ১৯৯৮-২০০১ সালে মূলত আইএমডিটি ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করা মামলাগুলি, সম্প্রতি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালগুলির কাছ থেকে নোটিশ পাওয়া শুরু করেছে। ২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী সর্বমোট ২,০১,৯২৮ জনের নাম ট্রাইবুনালে বিচারাধীন। যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে, তাঁদের উত্তরাধিকার যারা ব্যবহার করেছিলেন বা যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিচারাধীন ছিল, তাঁদের এনআরসি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই কারণে যদি আরও প্রায় ১,০০৯,৬৪০ মানুষকে বাদ দেওয়া হয়, তবে আবেদন করতেই পারেন নি এমন লোকের সংখ্যাটি প্রায় ১.৬০০,০০০ এর কাছাকাছি চলে যায়। এখানে স্মর্তব্য আসাম বিধানসভার তৎকালীন উপাধ্যক্ষের পরিবারের কয়েকজনের নামেও বিদেশি নোটিশ এসেছিল এবং বেশ কয়েকদিন ট্রাইব্যুনালে ছোটাছুটি করে তাঁদের সন্দেহমুক্ত হতে হয়।
এছাড়া যাঁদের নাম ডি ভোটার হিসাবে চিহ্নিত হলেও (১.২০ লক্ষ ডাউটফুল ভোটার) এখনও ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালগুলিতে রেফার করা হয়নি তাঁদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই আবেদন করতে অপারগ মানুষগুলির সংখ্যাকেও যুক্ত করতে হবে এনআরসি ছুটের সংখ্যায়। এনআরসি-র তালিকা বেরোনোর অনেক আগেই ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালগুলি বেশিরভাগ কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসেবে মূলত মুসলমান এবং প্রচুর বাঙালি হিন্দু ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশি হিসাবে চিহ্নিত করে বসে আছে।
অনেকে প্রশ্ন তুলছেন ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করার পর যাঁরা শরণার্থী হয়ে এসেছিলেন, তাঁরা কোথায়? বলা হয়ে থাকে যে ১০ কোটি শরণার্থী ভারতে ঢুকেছিল, তাঁদের নব্বই শতাংশ হিন্দু এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসামেই বসতি স্থাপন করেছিল। যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট ১৯৫১ সালের এনআরসি থেকে শুরু করে “উত্তরাধিকার” নথি হিসাবে ব্যবহার করার জন্য নির্ধারিত সব প্রমাণপত্রই একাত্তরের ২৫ শে মার্চ আগের হওয়া আবশ্যিক ঘোষণা করেছে, তাই যুক্তিসঙ্গত কারণেই যে তাঁরা এনআরসির জন্য আবেদন করতে পারেননি। এখন তাদের কী হবে? এখানেই সিএবি বা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আসে। বিজেপি কেবলমাত্র মুসলিমদের রাষ্ট্রহীন করে দিতে চায়। সমস্ত বাঙালি হিন্দুকে উদ্ধার করে নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য সে প্রতিশ্রুত। নাগরিকত্ব বিল (ভিত্তিবর্ষ ২০১৪) এবং এনার্সি (ভিত্তিবর্ষ ১৯৭১) পরস্পর বিরোধী। বিশেষত হিন্দুদের ক্ষেত্রে এনআরসি যাঁকে বিদেশি চিহ্নিত করলো, নাগরিকত্ব বিলের সুবাদে তিনি নাগরিক হয়ে যেতে পারেন। ফলে কোন প্রক্রিয়া অগ্রাধিকার পাবে তা আগে স্থির করা হোক। তবে কি এনআরসি এখন থেকে শুধু মুসলিম বিদেশি চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া হবে?
কিন্তু তাহলে বারো লক্ষ বাঙালি হিন্দু, পাঁচ লক্ষ মুসলমান, আর দু লক্ষ অসমীয়া ভূমি পুত্রের নাম বাদ পড়েছে, এই হিসেবটা এলো কোত্থেকে? আসলে বিজেপি এই অঙ্কটা ছড়িয়েছে। অন্যেরা নিজ নিজ স্বার্থে অঙ্কটা মেনে নিয়েছেন। ফলে ডেটা-স্ট্যাটিসটিক্স নির্মিত হচ্ছে সুবিধে অনুয়ায়ী। বারো লক্ষ হিন্দুর নাম অকারণে বাদ গেলে, সিএবি চালু করা লেজিটিমেট হয়ে গেল। অসমীয়ারাদের মুসলিম বিদ্বেষের ফলে আগের মত বিরোধিতা সেদিক থেকে নাও হতে পারে। বাঙালি হিন্দুদের একাংশ তো দু হাত তুলে আশীর্বাদ করবেন। এমনকি মুসলিম সংগঠনগুলিও মাত্র পাঁচ লক্ষ নাম বাদ যাওয়ায় খুশি চেপে রাখতে না পেরে পটকা ফাটাতে শুরু করে দিয়েছে। এবার আদালতের জন্য আইনি সহায়তার টুকটাক ব্যবস্থা করে খালাস হবে। দু লক্ষ অসমীয়া ভূমিপুত্রের নাম ঢোকাতে পারলে বিজেপি অসমীয়াদেরও নয়নমনি হয়ে উঠবে। বাঙালি সংগঠন গুলিও পায়ের তলায় জমি পাবে। অসমীয়া জাতীয়তাবাদী দলগুলি দু লক্ষ ভূমিপুত্রের জন্য কেঁদে ভাসাচ্ছে। কংগ্রেস আর বামপন্থীরা দাবি করবে, আমরা তো আগেই বলেছিলাম, বিজেপি খুব খারাপ। আমরা ছিলাম বলেই তো মাত্র উনিশ লক্ষে প্রক্রিয়াটাকে সালটানো গেল। নৈলে একচল্লিশ লাখই বাদ পড়ে যেতো।
কোনও সর্বভারতীয় বা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল, যারা আসামেও কাজ করে, তারা এনআরসি-র বিরোধিতা করে নি। আসামের বাঙালি হিন্দুরা, বাংলাদেশের বাঙালি হিন্দুর পাশে দাঁড়ান নি। আসামের বাঙালি মুসলমানেরা বাংলাদেশি মুসলমানদের তাড়াতে বদ্ধপরিকর। তার চেয়েও বড় কথা এনাআরসি বিধিতে ভিত্তিবর্ষ ১৯৭১। ১৯৪৬-৪৭ নয়। এমনকি সিএবি তেও ভিত্তিবর্ষ ২০১৪। ১৯৪৬-৪৭ নয়।
অসমীয়ারা খুশি হয়নি বিপুল পরিমাণ হিন্দু বাঙালি এবং মুসলিম বাঙালির নাম বিয়োজিত হয়নি বলে। হিন্দুরা খুশি হয়নি মুসলিম নাম কর্তন যা প্রত্যাশিত ছিল তার ধারে কাছে পৌঁছায় নি বলে। বাঙালিরা খুশি হয়নি তার কারণ এই নামকর্তনের তালিকায় প্রচুর পরিমাণে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম এবং অন্যান্য প্রদেশের বেশ কিছু লোকজন ঢুকে পড়ায়। প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলি কিছু পরিমাণে হলেও বেকুব বনে গেছে। আবার অনেক তথাকথিত ভূমিপুত্রের নাম, মহিলাদের নাম, এমনকি বিভিন্ন উপজাতি-জনজাতির নামও উনিশ লক্ষের তালিকায় ঢুকে পড়ায় অসমীয়ারা ক্ষিপ্ত।
অসমীয়া পত্রপত্রিকায় শুরু হয়েছে জাতিরক্ষার জন্য প্রতিটি খিলঞ্জীয়া অসমীয়া কে নিদ্রাজাগরণের আহ্বান জানানো । বলা হচ্ছে কাল পর্যন্ত ভয়ে ভয়ে থাকা বাংলাদেশিরা এখন বুক ফুলিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে জমির অধিকার চাইবে, রাজনৈতিক অধিকার চাইবে। পালে পালে সন্তানের জন্ম দিয়ে, দশ বছরের ভেতর আমাদের দ্বিগুণ জনসংখ্যা নিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে। অতএব অসমীয়া জাতির উদ্ধারের জন্য প্রচ্ছন্ন হুমকি সহ পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে প্রতিটি খিলঞ্জীয়া বহিরাগতদের জমি বিক্রি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করুক বা বাধার সৃষ্টি করুক। যে সব খিলঞ্জীয়া আগে থেকেই সন্দেহযুক্ত বাংলাদেশিদের কৃষিকাজ করার জন্য আধি তে নিয়োগ করেছিলেন, তাঁরা সেই জমি নিজের হাতে নিয়ে আসুন। আহ্বান জানানো হচ্ছে বরপেটা সত্রের যেসব জমি মিঁঞারা দখল করে আছে সেগুলো দখলমুক্ত করতে চলুন। জরুরি দাবি হিসাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কঠোর আইন বানানোর জন্য প্রত্যেকে সরকারের কাছে দাবি উত্থাপন করুক। কোন সন্দেহভাজন শ্রমিককে (এনআরসি তে নাম থাকলেও) কাজে লাগানো হবে না বা কাউকে লাগাতেও দেওয়া হবে না। সরকারের কাছে দাবি জানানো হচ্ছে যে আসামের চরে যারা মাটির জমি দখল করে আছে সেই গুলি দখলমুক্ত করার জন্য। নিজের প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিজে উৎপাদন করবো নইলে উপোস করে থাকবো, এই নীতিতে অর্থনৈতিক সংগ্রাম করতে প্রতিটি যুবক ঝাঁপিয়ে পড়তে বলা হয়েছে। চর এলাকায় সন্দেহযুক্ত মানুষের উৎপাদন করা কোন ধরনের শাকসবজি আমরা কিনবো না এই সংকল্প গ্রহণ করারও আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হচ্ছে এই ধরনের সিদ্ধান্ত যদি খিলঞ্জীয়া অসমীয়ারা না নেয়, তাহলে অসমীয়া জাতি বাঁচবে না। বোঝাই যায় একটি বিশেষ কমিউনিটি মানে মুসলিমদের অসমীয়া জাতিধ্বংসের মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করার প্রয়াস। এই সব পরামর্শ প্রয়োগ হতে শুরু করলে দীর্ঘস্থায়ী, রক্তক্ষয়ী, ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধ শুরু হবে। সে যুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্রবিরোধী আলফা আর হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রপূজক বিজেপি একই যুদ্ধাশ্বে সওয়ার।
মনে রাখতে হবে এনআরসি এবং ক্যাব দুটোই জনবিরোধিতার চক্রান্ত। দুটোকেই বাতিল করার দাবিতে আন্দোলন হওয়া উচিত। দেশভাগের সেন্টিমেন্টকে সুকৌশলে এই আলোচনায় এনে ফেলা হচ্ছে। এনআরসি-র সঙ্গে দেশভাগের আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
লেখক: ভারতীয় সমাজকর্মী