সুন্দরবন যেমন বিশ্ব ঐতিহ্য, তেমনি এটি আমাদের গর্বেরও প্রতীক। এই বনের আরেক অহংকার বাংলার বাঘ। সুন্দরবনে বাঘের উপস্থিতি এই বনের গুরুত্ব বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। বন্য প্রাণী গবেষক ও পর্যটকদের জন্য এই বাঘ তাই বাড়তি আকর্ষণ। এটি আমাদের সবারই জানা যে সুন্দরবন আমাদের বাঘের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। তবে পরিতাপের বিষয় হলো, সুন্দরবনে এই বাঘও খুব বেশি ভালো নেই। সরাসরি বাঘ শিকার, মানুষ কর্তৃক বাঘের প্রধান আহার হরিণ শিকার ও বাঘের আবাসের নানা রকমের হুমকির কারণে আমাদের বাঘ আজ মহাসংকটাপন্ন।
১৮ জুলাই প্রথম আলোর মতামত পাতায় টোপ দিয়ে বাঘের ছবি তোলা শীর্ষক একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে টোপ ব্যবহারের পক্ষে উপস্থাপিত যুক্তিগুলো যেমন গবেষণালব্ধ তথ্যনির্ভর নয়, তেমনি বাঘের বর্তমান সংকট উত্তরণে টোপ দিয়ে ছবি তোলার তেমন কোনো ভূমিকাও নেই। একজন বাঘ গবেষক হিসেবে লেখকের নিবন্ধের সঙ্গে কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে আমার মতামত তুলে ধরছি।
প্রচারের জন্য বাঘের ছবি তোলা দরকার বলে লেখক যুক্তি দিয়েছেন। গরু-ছাগল টোপ হিসেবে বাঘকে খাইয়ে সুন্দরবনের ছবি তুলে বা চলচ্চিত্র বানিয়ে প্রচার করলেই বাঘের প্রসার হবে। অর্থাৎ সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণ হবে বলে তিনি মনে করেন।
প্রকৃতপক্ষে কোনো প্রাণী সংরক্ষণ করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন ওই প্রাণীর বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত। যেমন বাঘ কী খায়, দৈনিক তার কতটুকু খাবার দরকার, কোথায় কখন ঘুমায় কিংবা তার বিচরণ এলাকা কেমন, ইত্যাদি। আর এসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে বাঘের ছবি তো দূরের কথা, বাঘ স্বচক্ষে না দেখলেও চলে।
বিজ্ঞানের নানা প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন বাঘের মতো নিভৃতচারী প্রাণীর জীবনাচরণ জানা যায়। লেখকের মতে, প্রচারের আরেকটি উদ্দেশ্য মানুষকে সচেতন করা। আসলে কোনো প্রাণী সংরক্ষণের জন্য মানুষকে সচেতন করার নানা উপায় আছে। ছবি বা চলচ্চিত্র একটি মাধ্যম হতে পারে। তাই বলে গরু-ছাগলের টোপ দিয়ে ছবি তুলতে হবে বা চলচ্চিত্র বানাতে হবে, এটি অনিবার্য তো নয়ই, নৈতিকভাবেও অসমর্থনযোগ্য।
লেখক ভারতের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বাঘ-রক্ষিত এলাকার কথা বলেছেন, যেখানে বাঘের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে ভারত কোটি কোটি রুপি আয় করছে। ফলে বাঘ সংরক্ষণের বিষয়টি প্রচার পাচ্ছে। আসল চিত্র হলো, ২০১৬-১৭ সালে বাঘ সংরক্ষণের জন্য ভারত সরকার
৩০০ কোটি রুপি বরাদ্দ দিয়েছিল। তারপরও বাঘ রক্ষায় তারা প্রতিনিয়ত গলদঘর্ম হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, বিগত ১৫ বছরে বাঘ আছে এমন দেশগুলোতে শিকারিদের হাতে প্রায় ১ হাজার ৭৫৫টি বাঘের প্রাণ গেছে। এর অধিকাংশ ঘটেছে ভারতের বিভিন্ন বাঘ-সংরক্ষিত এলাকায়। একই
সময় বাংলাদেশের সুন্দরবনে কমপক্ষে ৪১টি বাঘ শিকার করা হয়েছে।
লেখক বলেছেন, সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ করতে বাঘকে প্রচারে রাখতে হবে। এ জন্য বাঘের ছবি তোলা দরকার। লেখকের মতে, ২০০০ সালে মাইক হার্ড এবং ২০০৩ সালে রাজিয়া কাদির সুন্দরবনের বাঘকে গরু দিয়ে চলচ্চিত্র বানিয়ে প্রচার করার ফলে সুন্দরবনের প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। হতেও পারে। তবে বাংলাদেশ বন বিভাগের মতে, সুন্দরবনে তখন বাঘ ছিল ৪৪০ টি। ২০০৪ সালে সম্পাদিত একটি গবেষণায়ও সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৩০০-৫০০টি বলা হয়। ২০১১ সালে বাঘের চারটি চামড়া ও পাঁচটি খুলিসহ শরণখোলায় বাঘশিকারি জামাল ফকির আটক হওয়ার পর সুন্দরবনে ব্যাপক হারে বাঘ শিকারের বিষয়টি জানা যায়।
বাঘ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিগত দশকে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ভালো আছে বলে প্রচার পাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাঘ চোরাকারবারি ও শিকারিরা সুন্দরবনের ওপর নজর দিতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে বন বিভাগের টহলসহ নানা ধরনের তৎপরতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের পরও সুন্দরবনে বাঘ শিকার বন্ধ করা যায়নি। বর্তমানে সুন্দরবনে মাত্র শ খানেক বাঘ টিকে আছে। গরু-ছাগল দিয়ে বাঘের ছবি তুলে বা চলচ্চিত্র বানিয়ে প্রচার করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে বাঘ রক্ষা হবে না। বাঘ সংরক্ষণ করতে হলে নিয়মিতভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে বাঘ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণের চোরা শিকার যেকোনো উপায়ে রোধ করতে হবে।
সুন্দরবনের আশপাশের লোকালয়ের মৃত গবাদিপশু বনের গুইসাপ, শূকর ও বাঘ খেয়ে থাকে বলে লেখক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন। তিনি এ-ও বলেছেন যে তাতে তাদের কোনো ক্ষতি হতে দেখা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে, সুন্দরবনে এসব বিষয়ের ওপর কোনো গবেষণাই হয়নি এবং কোনো তথ্য-উপাত্তও নেই। সুতরাং এটা বলার কোনো সুযোগ নেই যে গরু-ছাগলের টোপ বাঘ বা বনের অন্যান্য প্রাণীর ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে না। বাঘের মল পরীক্ষা করে রোগ-জীবাণু শনাক্তকরণ শীর্ষক একটি গবেষণার অপ্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বাঘের মলে এমন সব পরজীবীর উপস্থিতি রয়েছে, যা সাধারণত গবাদিপশুর মধ্যেই দেখা যায়। সুতরাং এসব পরজীবী বাঘের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক। তদুপরি টোপ দেওয়া গরু-ছাগলের উচ্ছিষ্টাংশ অর্থাৎ নাড়িভুঁড়ি, মলমূত্র সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে। এ থেকে নানা রকমের রোগবালাই সুন্দরবনের হরিণ ও শূকরের মধ্যে সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে।
গবেষণামতে, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা থেকে চোরাকারবারিরা বন্য প্রাণীর অবৈধ মার্কেটে চাহিদাসম্পন্ন প্রাণী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে শিকারিদের কাছে সরবরাহ করে। শিকারিরা ওই তথ্য ব্যবহার করে বনে ওই প্রাণীর অবস্থান চিহ্নিত করে। ফলে শিকারিরা সহজে বাঘের মতো নিভৃতচারী প্রাণীও শিকার করতে সক্ষম হয়। এ কারণে অনেক বিজ্ঞান সাময়িকী এখন প্রাণীর অবস্থান প্রকাশ করাকে নিরুৎসাহিত করে থাকে।
বাঘ বাংলাদেশের জাতীয় প্রাণী। এই রাজকীয় প্রাণীটি আজ গভীর সংকটে রয়েছে। বর্তমানে সুন্দরবনই বাংলাদেশে বাঘ টিকে থাকার একমাত্র ভরসার জায়গা। সুন্দরবনে আমাদের বাঘ টিকিয়ে রাখতে না পারলে কম্বোডিয়ার মতো আমাদেরও একদিন ঘোষণা করতে হবে, বাংলাদেশে আর কোনো বাঘ বেঁচে নেই। সেদিনটি যেন কখনোই না আসে।
ড. এম এ আজিজ : বাঘ গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক