রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদ, সম্মানজনক ও স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে মার্কিন থিংক ট্যাংক ‘কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশনস’ আয়োজিত এক সংলাপে এ কথা বলেন তিনি।
প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের কারণে সৃষ্ট রোহিঙ্গা সঙ্কট বাংলাদেশের উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে বলে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘রোহিঙ্গা সঙ্কট সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার আর এ সমস্যার সমাধানও সেখানেই রয়েছে।’
‘এ কনভারসেশন উইথ প্রাইম মিনিস্টার শেখ হাসিনা’ শীর্ষক এ সংলাপে তিনি বলেন, ‘দ্রুত ও শান্তিপূর্ণভাবে আমরা এ সমস্যার (রোহিঙ্গা) সমাধান চাই।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘রোহিঙ্গা সঙ্কট আমাদের জন্য উদ্বেগজনক চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছে। পরিকল্পিত নৃশংসতার মধ্য দিয়ে মিয়ানমার সরকার তাদের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের নিধন করছে। তারা (রোহিঙ্গা) সহিংসতা ও নৃশংসতা থেকে পালাতে দেশ ছেড়েছে। আমরা মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের আশ্রয় দিয়েছি।’
বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছেন। যাদের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা এসেছেন ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে নতুন করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন শুরু হওয়ার পর। জাতিসংঘ ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান হিসেবে বর্ণনা করে আসছে।
মিয়ানমার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ায় দুই দফা চেষ্টার পরও রোহিঙ্গাদের কাউকে তাদের ভিটেমাটিতে ফেরত পাঠানো যায়নি। তাদের নিরাপদে, মর্যাদার সঙ্গে ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমানরকে বাধ্য করার ব্যবস্থা নিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কোটি মানুষের ভারতে আশ্রয় নেয়ার কথা স্মরণ করেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর ছোট বোন শেখ রেহানাসহ নিজের নির্বাসিত জীবনের কথাও তুলে ধরেন।
সেই মানবিক তাড়না থেকেই রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়া হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ সাধ্যমত তাদের মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহায়তা করছে।’
এ সঙ্কটের গভীরতা বুঝতে সবাইকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, ক্যাম্পে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা শুনলে আপনাদের বুকও কেঁপে উঠবে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার চিত্র আপনাদের হৃদয় নাড়িয়ে দেবে। আপনারা চাইবেন খুব দ্রুত যেন তাদের (রোহিঙ্গা) এই কষ্টের সমাপ্তি হয়।’
রোহিঙ্গা সঙ্কট ছাড়াও সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় নেয়া উদ্যোগগুলোর কথা শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।
সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম ও সীমানা নেই মন্তব্য করে সন্ত্রাস, চরমপন্থা ও সংঘাত বন্ধে চার দফা পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব রাখেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের যোগান অবশ্যই বন্ধ করতে হবে; তাদের অর্থের যোগান বন্ধ করতে হবে; সামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে হবে।’
বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও চরমপন্থা নির্মূলে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং সফলতার তথ্যও প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও খরার তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও অ্যাকশন প্ল্যান নিয়েছে। নিজস্ব অর্থে ক্লাইমেট চেইঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা হয়েছে। ওই তহবিল থেকে কয়েকশ প্রকল্পে ইতোমধ্যে ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করা হয়েছে।’
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও বাংলদেশ এগিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পিপিআইয়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩০তম অর্থনীতি। এ বছর বাংলাদেশ রেকর্ড ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পেয়েছে। দুই অংকের প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিনও খুব বেশি দূরে নয়। স্পেকটেটরের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত দশ বছরে বাংলাদেশ বিশ্বে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।’
পরে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন এবং রোহিঙ্গা সঙ্কট, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের পরিস্থিতি, খাদ্য ও সামাজিক সুরক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সংলাপ হয়েছে এবং এখনো আলোচনা চলছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এ বিষয়ে সমর্থন দিচ্ছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সমস্যা হলো, সেখানে নিরাপত্তাহীনতার কারণে তারা (রোহিঙ্গারা) ফিরে যেতে চায় না।’
১৯৮২ সালে মিয়ানমার সংবিধান পরিবর্তন করে রোহিঙ্গাদের কীভাবে নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। সংবিধান পরিবর্তন করে সেখানে রোহিঙ্গাদের তাদের নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি এবং তাদের (রোহিঙ্গাদের) বহিরাগত হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিয়ানমারের একটি পরিবেশ তৈরি করা উচিত যাতে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে পারে এবং তাদের নিজস্ব ভূমিতে বসবাস করতে পারে।’
মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি যখন মক্কায় ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছি, তখন আমি