ঘটনা- ১: ‘তোর কিছু ন্যুড ছবি আমার কাছে আছে। এখনি আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা বিকাশ কর, না হলে এগুলো নেটে ছেড়ে দিবো’। ফোনে এই কথাগুলো শুনতে শুনতেই রীতিমতো ঘাম ছুটেছে রুম্পা তাবাসসুমের। ওপাশ থেকে বলা কথাগুলোর কারণে ভয়ে গলাটা ধরে আসছে। হাত-পা কেমন অসাড় হয়ে আসছে। বিভিন্ন এলোমেলো চিন্তা আসছে তার মনে। কে এই কাজটা করতে পারল? কাকে দোষ দিবে সে?
রাজধানীতে ও লেভেলে পড়া স্মার্ট এই মেয়েটি বেশ কিছুদিন আগে বিশ্বাস করে তার বয়ফ্রেন্ডকে এমন ছবি দিয়েছিল। সে সম্পর্ক এখনো কন্টিনিউ। এছাড়া আরো দু’জনকে এমন ছবি দিয়েছে সে। সবার সাথেই তার ভালো সম্পর্ক। এ নিয়ে কাকে সন্দেহ করবে, সে কনফিউজড।
ঘটনা-২ : ঠাকুরগাঁওয়ের এক গৃহবধূকে ঘরে আটকে রেখে নগ্ন ছবি ধারণ করেন ইউপি সদস্য অশ্বিনী কুমার বর্মণ (৩২)। এরপর এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করাসহ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্যও চাপ প্রয়োগ করেন। না করলে তার সেই নগ্ন ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেবার হুমকি দেন সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সেই ইউপি সদস্য। লোকলজ্জার ভয়ে ওই গৃহবধূ তার স্বামীকেও ঘটনাটি না জানিয়ে ঘরে থাকা ২০ হাজার টাকা দেন। টাকা পেয়ে অশ্বিনী কুমার অবশিষ্ট ৮০ হাজার টাকার জন্য আবারো চাপ প্রয়োগ করেন, একইসাথে দৈহিক সম্পর্ক না করলে অশ্লীল ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চলে যান।
ঘটনা-৩ : প্রেমের প্রস্তাবে ব্যর্থ হয়ে গাইবান্ধার পলাশবাড়িতে এক স্কুলছাত্রীর ছবি তুলে তা পর্নো ছবির সাথে জুড়ে দেয় দুই যুবক। ৬ষ্ঠ শ্রেণির ওই ছাত্রীকে বার বার প্রেম নিবেদন করতেন স্বপন সরকার ও তার সহযোগী ইমরান হাসান। তারা মেয়েটির স্কুলে যাওয়া আসার পথে প্রায়ই উত্যক্ত করতো। বখাটে দুজনের উৎপাতে অতিষ্ট হয়ে বাবা মেয়েকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ দেন। এরপর বিয়েও দিয়ে দেন। এতে ওই বখাটেরা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা ওই মেয়ের বিয়ের ছবি তুলে নিজের ছবির সাথে অশ্লীল ভঙ্গিতে জুড়িয়ে ফেসবুকে পোস্ট করে।
এ ধরনের ঘটনা আমদের সমাজে এখন অহরহ ঘটছে। দিন দিন প্রযুক্তি ব্যবহারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার হয়রানির মতো সমস্যা। আর এসব সমস্যায় সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন নারী ও শিশুরা।
ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, গুগল, স্কাইপিতে ভুয়া আইডি খুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল, ব্লগে মিথ্যা মানহানিকর তথ্য প্রচার, বিভিন্ন অ্যাপসে অশ্নীল ছবি, ভিডিও ও মেসেজ পাঠিয়ে উত্ত্যক্ত করছে সাইবার অপরাধীরা। ফিশিংয়ের মাধ্যমে অন্যের আইডি হ্যাক করে প্রতারণাও করা হচ্ছে। সাইবার অপরাধীদের শিকার ৫২২ জনকে নিয়ে পুলিশের এক গবেষণায় দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের ৭০ শতাংশই নারী। তাদের মধ্যে ১৫ থেকে ২৫ বছরের কমবয়সী নারী ৫৭ শতাংশ। এসব সাইবার অপরাধের ধরনের মধ্যে রয়েছে সাইবার পর্নোগ্রাফি ১৪ শতাংশ, হ্যাকিং ২০ শতাংশ, মানহানি ১৮ শতাংশ, ভুয়া আইডি ২০ শতাংশ ও অন্যান্য ছয় শতাংশ।
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন নামক একটি বেসরকারি সংস্থা ২০১৮ সালের মে মাসে ‘বাংলাদেশ সাইবার অপরাধের প্রবণতা শীর্ষক’ এক গবেষণা প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সি মেয়েরা। আর ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৮ বছরের কম মেয়েদের সংখ্যা ১০.৫২ শতাংশ, ১৮ থেকে ৩০ বছরের কম নারীর সংখ্যা ৭৩.৭১ শতাংশ, ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সী নারীর সংখ্যা ১২.৭৭ শতাংশ এবং ৪৫ বছরের বেশি নারীর সংখ্যা ৩ শতাংশ।
এ হিসাব কেবল রাজধানী ঢাকার। ঢাকার বাইরের চিত্রও প্রায় একই রকম। হয়রানির শিকার নারীদের ৩০ শতাংশই এর বিরুদ্ধে কীভাবে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় সে বিষয়ে জানেন না। বাকিদের মধ্যে ২৫ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হবে না ভেবে অভিযোগ করেন না। আবার অভিযোগ করেও আশানুরূপ ফল পাননি ৫৪ শতাংশ ভুক্তভোগী। আবার মফস্বলে অনলাইনে হয়রানির শিকার বেশিরভাগ ভুক্তভোগী থানায় যান না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষতার অভাবে অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে সাইবার অপরাধের বিষয়গুলো তদন্তে হিমশিম খেতে হয়।
সাইবার হয়রানির বিষয়ে নিজেদের সচেতন হবার পরামর্শ দিয়ে লেখক ও নাগরিক সাংবাদিক রোদেলা নীলা রাইজিংবিডিকে জানান, অনলাইন জীবনেও একটি পরিমিতিবোধ থাকা দরকার। ইমোশনাল হয়ে ব্যক্তি জীবনের কথা অনেকেই সোশ্যাল মাধ্যমে লিখি। পরে যতোই ডিলিট করি না কেন ডাটাতে কিন্তু সব থেকে যাচ্ছে। তাই নিজের মনের রিমোট রাখতে হবে নিজে হাতেই। আমার ঘরের নিরাপত্তা প্রথম আমাকেই দিতে হবে। ঘরের দরজা খুলে রেখে চুরি হবার দায় নিশ্চয়ই আমি রাষ্ট্রকে দিতে পারি না। তেমন করেই আমার অনলাইনে কোনো পোস্ট শেয়ার দেবার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে কোন পোস্ট পাবলিকে যাবে, আর কোন পোস্ট হবে শুধুই বন্ধুদের জন্য। আর কতোটুকু লিখলে তা পরিমিতিবোধ ছাড়িয়ে যাবে না, সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। তবেই সুরক্ষিত থাকবে এই ডিজিটাল এবং অ্যানালগ জীবন।
অনলাইন মৌলিক মানবাধিকার চর্চায় আইনি চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির আইন বিষয়ক জ্যৈষ্ঠ প্রভাষক সাইমুম রেজা তালুকদার রাইজিংবিডিকে বলেন, অফলাইনের মৌলিক মানবাধিকারগুলো অনলাইনেও কার্যকর হবে কিনা সে বিষয়ে আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। অনলাইনে ‘তথ্যের সুরক্ষা’ (ডাটা প্রটেকশন), বিদ্বেষমূলক বক্তব্য (হেইট স্পিচ), ব্যক্তিগত সুরক্ষার বিষয়েও আইনে সুষ্পষ্ট কোনো সংজ্ঞাও নেই। এছাড়া অনলাইন অপরাধের বিপুল অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য বিদ্যমান সাইবার ট্রাইবুন্যাল যথেষ্ট নয়। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে হয়রানির সকল প্রমাণ সংরক্ষণ করতে হবে।
নারীদের সাইবার সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা আর্টিকেল নাইনটিনের বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, প্রযুক্তিকে ভয় নয় বরং এর প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক দিক জেনে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ প্রযুক্তির ব্যবহার জানা ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। ডিজিটাল লিটারেসি বা প্রযুক্তি শিক্ষার মাধ্যমে নারীরা অনলাইনে বুলিংয়ের মতো নেতিবাচক বিষয় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন।
এ বিষয়ে ব্যক্তিগত সুরক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন প্রযুক্তি ও অ্যাপ ব্যবহারের সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভূমিকার শুরুতেই ‘নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের’ কথা বলা হয়েছে। অথচ আইনের কোনো ধারায় নিরাপত্তার বিধান নাই। তাই অনলাইনে বিচরণের ক্ষেত্রে পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে পার্থক্য রাখাটা জরুরি। আইনি সুরক্ষার আগে অনলাইন ব্যবহারীকে অবশ্যই প্রযুক্তির কারিগরি দিকগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে।
সাইবার ক্রাইম ও সাইবার সিকিউরিটি ডিভিশনের (ডিএমপি) অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মিশুক চাকমা জানান, হয়রানির শিকার একজন ভুক্তভোগীকে সর্বপ্রথম মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। বিচলিত হয়ে এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যা তার পরিস্থিতির বিপক্ষে চলে যায়।
সাইবার অপরাধ তদন্তে নিজেদের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সাইবার অপরাধীদের শনাক্ত, গ্রেপ্তার ও অভিযোগ প্রমাণ করা সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের জন্য সময়সাপেক্ষ ও বেশ চ্যালেঞ্জিং। পুলিশের একার পক্ষে সাইবার অপরাধ মোকাবেলা সম্ভব নয়। এজন্য পরিবার থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
এছাড়া অনলাইনে হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ জানাতে সাইবার নিরাপত্তা বিভাগের ফেসবুক পেজে (www.facebook.com/cyberctdmp) এবং হেল্প ডেস্কে (০১৭৬৯৬৯১৫২২) যোগাযোগ করার জন্য পরামর্শ দেন তিনি।