সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত ছাত্রলীগের শীর্ষ দু’নেতাল বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। একই সময়ে যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তিনি। এর পরই শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান, যা ধীরে ধীরে আরো জোরদার হচ্ছে।
এদিকে চলমান শুদ্ধি অভিযানের পর থেকেই গোমর ফাঁস হতে শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন কেউ কেউ। রেড অ্যালার্ট জারি হয়েছে আরো কয়েক জনের বিরুদ্ধে। শুদ্ধি অভিযানে এখনো পর্যন্ত যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তাদের সবাই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। ফলে দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারনী পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দুর্নীতি-অনিয়ম রুখতে শুরু হয়েছে এই শুদ্ধি অভিযান। আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আসায় দলের ভেতরেও বহু অনুপ্রবেশকারী বিভিন্নভাবে জায়গা করে নিয়েছে। আর দলের নাম ভাঙ্গিয়ে যে সব অপকর্ম হচ্ছে, সেগুলোর নেপথ্যে রয়েছে এসব সুবিধাভোগী। তাই নিজেরে ঘর থেকেই শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন ক্ষমতাসীনরা।
এদিকে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে ক্রমান্বয়ে কঠোর থেকে কঠোরতর হচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি জাতিসংঘের ৭৪তম অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে নিউ ইয়র্কের ম্যারিয়ট মারকুইজ হোটেলে এক নাগরিক সংবর্ধনায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি এবং মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছি। একটা কথা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই– যদি কেউ অসৎ পথে অর্থ উপার্জন করে, তার এই অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খলতা বা অসৎ উপায় ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে। সে যেই হোক না কেন, আমার দলের হলেও তাকে ছাড় দেয়া হবে না।
উন্নয়ন প্রকল্পসমূহে অনিয়মের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার উন্নয়নের জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ আরো বেশি উন্নত হতে পারতো যদি প্রকল্পের প্রত্যেকটি টাকা যথাযথভাবে ব্যয় করা হতো। তিনি বলেন, এখন আমাদের খুঁজে বের করতে হবে কোথায় ফাঁক-ফোকর রয়েছে, কারা এই কাজগুলো করছে এবং কীভাবে। আরেকটা জিনিস আমি দেখতে বলে দিয়েছি, সেটা হলো– কার আয়-উপার্জন কত? কীভাবে জীবন-যাপন করে? সেগুলো আমাদের বের করতে হবে। তাহলে আমরা সমাজ থেকে এই ব্যাধিটা, একটা অসম প্রতিযোগিতার হাত থেকে আমাদের সমাজকে রক্ষা করতে পারবো, আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারবো।
এদিকে শেখ হাসিনার এমন কঠোর বার্তার পরপরই একই সুরে কথা বলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দলের অভ্যন্তরে যে সব অপরাধী রয়েছেন তাদের খুঁজে বের করে তাদের বিতাড়িত করার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার ছবি ব্যবহার করে অপকর্ম করবে, দুর্নীতি করবে, লুটপাট করবে, ভূমি দখল করবে তারা আওয়ামী লীগের লোক হতে পারে না। আমাদের লোকের অভাব নেই, খারাপ লোকের দরকার নেই। গুটি কয়েক দুর্নীতিবাজ, লুটেরা-মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজদের জন্য গোটা পার্টির দুর্নামের ভাগিদার হতে পারে না। তাদের বর্জন করুন।
আগামী কাউন্সিলসহ নেতৃত্ব নির্বাচনে ক্লিন ইমেজের নেতাদের অগ্রাধিকার দেয়ারও ইঙ্গিত দেন ওবায়দুল কাদের। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে পার্টির ক্লিন ইমেজ গড়ে তুলতে হবে। ক্লিন ইমেজ করতে হলে আমাদেরকে পরগাছা মুক্ত আওয়ামী লীগ গড়ে তুলতে হবে। সেটাই শেখ হাসিনার স্বপ্নের আওয়ামী লীগ। সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আওয়ামী লীগ। আজকে দুঃসময়ের কর্মীরা আওয়ামী লীগে কোণঠাসা হবে, সে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ নয়। সে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নয়। দুঃসময়ের নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে যাবে সেটা আওয়ামী লীগ নয়, আওয়ামী লীগের আদর্শ সেখানে নেই।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী অপকর্মে জড়িতে তাদের তালিকা এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। যারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে আছে তাদেরও আইনের আওতায় আনার প্রস্তুতি চলছে। একই সাথে অনুপ্রবেশকারীদের দুই ধরনের তালিকাও করেছে দলটি।
আওয়ামী লীগ ’৯৬ সালে সরকার গঠনের পর যারা অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগের যুক্ত হয়েছেন এবং যারা ’০৮ সালের পর আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন তাদের আলাদা আলাদা তালিকা করা হয়েছে। তবে ’০৮ সালের পর যারা আওয়ামী লীগে যুক্ত হয়ে অপকর্মে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে আগে ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। এছাড়া দলীয় পদে থেকে যারা দুর্নীতির সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। একই সাথে অনিয়ম-দুর্নীতিতে সরাসরি যুক্ত না থেকে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করলেও শাস্তির ক্রমান্বয়ে আওতায় নিয়ে আসা হবে। এর এতেই ফেঁসে যেতে পারেন রাঘব-বোয়াল অনেক রাজনীতিবিদ।
এদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের কঠোর বক্তব্যের পর কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দলের অপরাধীরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। অভিযান পরিচালিত হওয়ার পর থেকেই অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন। আবার নতুন করে অনেকের নাম উঠে আসছে। সম্প্রতি দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে ছাত্রলীগের শীর্ষ দু’নেতা শোভন-রাব্বানীকে পদচ্যুত হয়েছে। ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই অপরাধে গ্যান্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের দুই নেতার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নগট টাকা ও স্বর্ণ উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া জিকে শামীমসহ আরো আরো কয়েক আটক হয়েছেন বিভিন্ন অভিযোগে। সরকারের এমন কঠোর অবস্থানের পরপরই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের বেশ কয়েক প্রভাবশালী শীর্ষ নেতা গা ঢাকা দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করছেন, দেশে চলমান শুদ্ধি অভিযানের ফলে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এই ধরনের কার্যক্রম ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
আওয়ামী লীগের শুদ্ধি অভিযান প্রসঙ্গে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার মেসেজ পরিষ্কার। কোনো ধরনের অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সেটা যদি আমাদের দলের লোকও হয় তারাও শাস্তির আওতায় আসবেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে দেশ যেভাবে সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেই সফলতায় যারা কালিমা লেপন করছে, তারা আর যাই হোক বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী নয়। এই ধরনের কার্যক্রমে বিএনপি-জামায়াত বাদে সবাই খুশি। আর তারা অখুশি, কারণ বাংলাদেশে বিভিন্ন অপরাধের জন্মই দিয়েছিলো তারা। এ কারণে অপরাধীদের পাশাপাশি তাদের দলের নামও চলে আসছে। সূত্র: বাংলাদেশ জার্নাল