প্রতারণার জাদুকর সাহেদ
‘তোরে এতো গুলি করবো, শরীরে আর জায়গা থাকবে না। লাশ ভাসাইয়া দিবো বুড়িগঙ্গায়।’ গত ৩০ জুন পাথর ও বালু সরবরাহ বাবদ ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকার বিল চাইতে গেলে সুনামগঞ্জের ছাতকের এখলাস খানের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে এমন হুমকি দেন প্রতারণার জাদুকর সাহেদ। গত কয়েকদিনে ভয়ঙ্কর এই প্রতারকের বিরুদ্ধে দেড় শতাধিক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। সাহেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রীতিমতো পাহাড়সম। বিশেষ করে র্যাবের পক্ষ থেকে হটলাইন নম্বর খোলার পর গতকাল বেলা ২টা পর্যন্ত ১৪০ জন ভুক্তভোগী ফোনে এবং ই-মেইলে অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে, শনিবার দিবাগত রাতে রিমান্ডে থাকা সাহেদকে নিয়ে উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধার করেছে ডিবি পুলিশ। এ ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। জানা গেছে, সাহেদের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে বেশিরভাগ প্রতারণার অভিযোগ। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া, রিজেন্টের কর্মচারীদের বেতন না দেওয়া, সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেওয়া ছিল অন্যতম। এর বাইরে বিভিন্ন দফতরে বদলির সুপারিশের আশ্বাস দিয়ে বিশাল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ, বিভিন্ন জায়গায় বালু ভরাট, রড-সিমেন্ট সাপ্লাইয়ের কথা বলে টাকা আত্মসাৎ, রিজেন্ট হাসপাতালে সেবার নামে অতিরিক্ত ফি আদায়, রিকশা-ভ্যানের ভুয়া লাইসেন্স দেওয়ার তথ্য মিলেছে সাহেদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া রিজেন্টের এমডি মাসুদ পারভেজ ও সাহেদের বিরুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক থেকে ফোন দিয়ে ঋণ নেওয়া সংক্রান্ত অভিযোগ মিলেছে।
র্যাবের সদর দফতরের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, সাহেদের বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য গত ১৭ জুলাই র্যাবের একটি সেবা লাইন (হেল্পলাইন- ০১৭৭৭৭২০২১১) চালু করি। সেবা লাইনের উদ্দেশ্য ছিল যারা রিজেন্ট হাসপাতাল বা সাহেদ করিমের হাতে প্রতারিত হয়েছেন তাদের আইনি পরামর্শ ও আইনি সহায়তা দেওয়া। এ ছাড়া একটি অফিশিয়াল ই-মেইলে বিস্তারিত তথ্যের জন্য আহ্বান জানাই। রবিবার পর্যন্ত ১২০টি ফোনকল ও ২০টি ই-মেইলে তার রিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে। সাহেদের প্রতারণার শিকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকেই। অনেকটাই নিঃস্ব হয়ে পথে বসে গেছেন। দিনের পর দিন তার উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের অফিসে ঘুরেও কোনো সমাধান পাননি। উল্টো সাহেদের টর্চার সেলে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে অনেককে। থানায় গেলেও সাহেদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে চাইত না পুলিশ। ভুক্তভোগী উত্তরার রিয়াদ রহমান বলেছেন, ২০১৯ এর এপ্রিলের শেষে এবং মের শুরুতে পূর্বাচলে সাহেদের একটি প্রজেক্টে এসকেভেটর, ড্রাম ট্রাক, ড্রেজার এবং শ্রমিক সরবরাহের জন্য ওয়ার্ক অর্ডার দেয়। বিল দেওয়ার কথা থাকে ১০ দিন পরপর। একপর্যায়ে ৪৪ লাখ টাকা বিল হওয়ার পর আড়াই মাস কাজ বন্ধ করে দেই। তার অফিসে ৬-৭ মাস ঘুরে ১৮ লাখ টাকা পাই।
রিয়াদ আরও বলেন, সাহেদ নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক এপিএস বলতেন। ফোন দিলেই বলতেন ডিজিএফআইর অফিসে মিটিংয়ে। সামনে পিছনে দুটি গাড়ি। তার সঙ্গে তিনটা শটগান নিয়ে থাকত দেহরক্ষী। তার নিজের সঙ্গে থাকত ৯ এমএম পিস্তল। অফিসে কথা বলার সময় সে সব সময় পিস্তল ঘুরাত।
র্যাব কর্মকর্তা আশিক বিল্লাহ বলেন, র্যাবের কাছে সাহেদের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা ফোন দিয়েছেন। সাহেদ তাদের বেতন দিতেন না বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। সাহেদ ও মাসুদের প্রতারণার বিষয়ে বিদেশ থেকেও আমাদের কাছে ফোনকল আসে। বিদেশের অনেকেই এই দুজনের কাছে প্রতারিত হয়েছেন বলে ফোন করেছেন। যারা বিদেশ থেকে ফোন করেছেন তাদের অভিযোগ অর্থ সংক্রান্ত প্রতারণা। যেসব ফোনকল ও ই-মেইল পেয়েছি সবগুলোর মূল অংশ ছিল আর্থিক লেনদেন। আমাদের কাছে আসা অভিযোগ অনুযায়ী, সাহেদ আনুমানিক ১০ কোটি টাকার মতো প্রতারণা করেছেন। আগামী ৫ দিন এই হটলাইনে অভিযোগ নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, সাহেদ ও রিজেন্ট সংক্রান্ত মামলার তদন্তভার নেওয়ার জন্য র্যাব পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে র্যাব তদন্তভার নেবে। যেহেতু র্যাব শুরু থেকেই এ মামলা করছিল, এরই ধারাবাহিকতায় আমরা তদন্তের কাজ করার জন্য আবেদন করি। প্রতারকের যে ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত সবই তার মধ্যে আছে। সাধারণ মানুষ তার গুরুত্বপূর্ণ আবহ দেখে তাকে বিশ্বাস করতেন।
সাহেদের বিরুদ্ধে হত্যা-নির্যাতনের মতো ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, হত্যার মতো ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ পাইনি। যেসব পেয়েছি সবই প্রতারণার। তবে হাসপাতালে একটি টর্চার সেল ছিল, সেখান থেকে আমরা কিছু জিনিস জব্দ করেছি। তিনি খুব মারপিট করতেন। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতেন। উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তপন চন্দ্র সাহা বলেন, শনিবার রাতে ডিবি সদস্যরা সাহেদকে নিয়ে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপদ রোডের ৬২ নম্বর বাসার সামনে অভিযান চালায়। সেখানে সাহেদের নিজস্ব সাদা প্রাইভেটকার ছিল। সেই প্রাইভেটকারে তল্লাশি চালিয়ে ডিবির সদস্যরা পাঁচ বোতল বিদেশি মদ, ১০ বোতল ফেনসিডিল ও একটি পিস্তল উদ্ধার করে। একটি গুলিও উদ্ধার করা হয়। এরপরই অস্ত্র ও মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করা হয়। এই থানায় এ পর্যন্ত সাহেদের বিরুদ্ধে পাঁচটি প্রতারণাসহ সাতটি মামলা হলো।
অন্যদিকে প্রতারক সাহেদের কথিত মালিকানাধীন পত্রিকার নামে করা তার অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে সরকার। একটি পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে তিনি এই কার্ড নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। গতকাল প্রধান তথ্য কর্মকর্তা সুরথ কুমার সরকার বলেন, এ বিষয়টি আমাদের নীতিমালার মধ্যেই বলা আছে। যদি কেউ প্রতারণামূলক কাজের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে তাহলে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল হয়ে যাবে। তাই আমরা তার কার্ডটি বাতিল করেছি। সাহেদ দৈনিক নতুন কাগজ নামে একটি পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড নেন। কার্ডের নম্বর-৬৮৪৫। গত বছরের ৩ ডিসেম্বর তার কার্ডটি ইস্যু করে তথ্য অধিদফতর। কার্ডের মেয়াদ ছিল চলতি বছরের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র্যাব। অভিযানে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট, করোনা চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়ম উঠে আসে। পরে রোগীদের সরিয়ে রিজেন্টের উত্তরা ও মিরপুর শাখা সিলগালা করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে পলাতক ছিলেন সাহেদ। তবে ১৫ জুলাই সাতক্ষীরা সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরদিন ১৬ জুলাই সাহেদ এবং রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুদ পারভেজকে ১০ দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত। আর সাহেদের প্রধান সহযোগী তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক শিবলীকে সাত দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়। মামলার তদন্তভার এখন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হাতে।
II বাংলাদেশ প্রতিদিন II