কোরআনে বর্ণিত একজন জান্নাতি নারীর শেষ আকাঙ্ক্ষা
ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুজাহিম ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা ঈমানদার সম্রাজ্ঞী। প্রখর বুদ্ধিমত্তা, আভিজাত্য ও অর্থ-সম্পদে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। ফেরাউনের রাজপ্রাসাদে আল্লাহর নবী মুসা (আ.)-এর লালন-পালনের ব্যবস্থার মূলে ছিলেন তিনি। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘ফেরাউনের স্ত্রী বলল, সে [মুসা (আ.)] আমার ও তোমার চক্ষুশীতলকারী হবে, তোমরা তাকে হত্যা কোরো না, হয়তো সে আমাদের উপকার করবে কিংবা আমরা তাকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করব, তারা তা অনুধাবন করতে পারেনি।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৯)
ফেরাউনের ঘরে থেকেও নিজের বুদ্ধি-জ্ঞানকে স্বাধীন চিন্তার জন্য উন্মুক্ত করেন। রাজপ্রাসাদের সব রকম বিলাসিতা ত্যাগ করে স্বামীর ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন। এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার কথা জানতে পেরে আসিয়ার প্রতি ফেরাউন ক্রোধান্বিত হয়। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনায় ফেরাউন আসিয়ার সঙ্গীদের হত্যা করে।
অতঃপর ঈমান প্রত্যাহার করতে আসিয়াকে নানাভাবে প্রলোভন দেখাতে থাকে। কিন্তু নিরাশ হয়ে বনি ইসরাঈলের মুমিনদের মতো নিজের জীবনসঙ্গী আসিয়াকেও কঠিন শাস্তি দেওয়া শুরু করে ফেরাউন। বরং আসিয়াকে অন্যদের চেয়ে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়। হাতে ও পায়ে লোহার পেরেক লাগিয়ে অদম্য প্রহারের নির্দেশ দেয় ফেরাউন। কঠিন নির্যাতনেও ধৈর্যহারা হননি আসিয়া। পুরো দেহ ক্ষতবিক্ষত হলেও নিজের ঈমানকে রক্ষা করেন তিনি। পাহাড়ের চেয়েও কঠিন ঈমান ধারণ করেন নিজের মধ্যে। ঈমানের ওপর দৃঢ়তার জন্য বিরল সম্মাননা পান তিনি। আল্লাহ তাআলা আসিয়াকে সৃষ্ট জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নারীদের তালিকাভুক্ত করে চিরকালের জন্য সম্মানিত করেন।
নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে শেষ মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে আসিয়ার। মৃত্যুকালে আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে বিশেষ দোয়া করেন। আল্লাহর কাছে আবদার করেন, যেন জান্নাতে তাঁর জন্য একটি ঘর তৈরি করা হয়। এ মহীয়সী নারীর জীবনের শেষ আকাঙ্ক্ষা আল্লাহ তাআলার পছন্দ হয়। তাই আল্লাহ আসিয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেন।
ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ মুমিনদের জন্য ফেরাউনের স্ত্রীর উপমা পেশ করছেন, তিনি বলেন, হে আল্লাহ, আমার জন্য জান্নাতে আপনার কাছে একটি ঘর নির্মাণ করুন এবং আমাকে ফেরাউন ও তার কার্যাবলি থেকে রক্ষা করুন এবং আমাকের জালেম জনগোষ্ঠী থেকে রক্ষা করুন।’ (সুরা : তাহরিম, আয়াত : ১১)
ইবনে কাসির (রহ.) বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাআলা তাঁর দোয়া কবুল করেন। জান্নাতে নিজের বাড়িও দেখতে পান। নিজচোখে বাড়ি দেখে হেসে দেন। এদিকে চরম নির্যাতনের মধ্যে আসিয়ার মুখে হাসি দেখে ফেরাউনের ক্রোধ আরো বাড়ে। ফেরাউন বলল, দেখছ, কী উন্মাদ হয়ে গেছে! আমরা তাঁকে চরম শাস্তি দিচ্ছি। আর সে হাসছে। ক্ষোভে ফেরাউন এক প্রকাণ্ড প্রস্তর নিক্ষেপ করে। এর পরই আসিয়া মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অবিশ্বাসী মহলের একজন সম্রাজ্ঞী হয়েও পৃথিবীবাসীর জন্য রেখে যান ঈমানি দৃঢ়তার চির আদর্শ। পার্থিব জীবনের সব বিলাসিতা পরিত্যাগ করে পাড়ি জমান অনন্তের পথে।
পৃথিবীর পুণ্যবতী নারীদের একজন আসিয়া। আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘পুরুষদের মধ্যে অনেকে পূর্ণতা অর্জন করেছেন। তবে নারীদের মধ্যে পূর্ণতা অর্জন করেছেন কেবল মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া। আর সব খাবারের মধ্যে সারিদ যেমন শ্রেষ্ঠ, তেমনি সব নারীদের মধ্যে আয়েশা শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৪১১ ও মুসলিম, হাদিস : ২৪৩১)
ঈমানি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নারীদের একজন আসিয়া। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) জমিনে চারটি রেখা টেনে বলেন, ‘তোমরা কি জানো এটা কী?’ সাহাবারা বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল জানেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘জান্নাতবাসীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নারী হলেন খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুজাহিম।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৯০৩)
ফেরাউনের স্ত্রী হয়েও আসিয়া পৃথিবীর ইতিহাসে অবিচলতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরও দ্বিন পালনে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন।