২০২০' শীর্ষ ব্যবসায়ীদের হারানোর বছর
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য আর অর্থনীতিতেই ক্ষত সৃষ্টি করেনি, ব্যবসায়ীদের মনে ক্ষত সৃষ্টি করে প্রাণ কেড়ে নিয়েছে অনেক ছোট-বড় উদ্যোক্তার। করোনা ছাড়াও শারীরিক জটিলতায় এবং বার্ধক্যেও অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের স্বনামখ্যাত প্রায় অর্ধশত ব্যবসায়ীকে হারিয়ে শোকাহত ব্যবসায়ী সমাজ।
দেশবরেণ্য খ্যাতনামা ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা আবদুল মোনেম, এম এ হাসেম, লতিফুর রহমান, নুরুল ইসলাম বাবুল, ইমামুল কবির শান্ত, শেখ মোমিন উদ্দিনকে হারানোর শোক সইতে পারছেন না স্বজনরা। সমব্যথী হয়েছেন ব্যবসায়িক সহযোদ্ধারাও। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘২০২০ সালে আমরা অনেক ব্যবসায়ীর মৃত্যু দেখেছি। তাঁরা সবাই নিজ নিজ খাতে বিশাল অবদান রেখে গেছেন। নিজ গুণ আর পরিশ্রমে সব মহলে স্থান করে নিয়েছেন। এসব মানুষের অবদানে দেশ ও অর্থনীতি এগিয়ে গেছে। আগামীর উন্নত বাংলাদেশ ও ব্যবসায়ী সমাজ তাঁদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাবে গভীর মমতায়।’
আবদুল মোনেম : দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যবসায়ী গোষ্ঠী মোনেম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও খ্যাতনামা ব্যবসায়ী আবদুল মোনেম না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। তিনি ১৭ মে স্ট্রোক করেন। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩১ মে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৮৬ বছর বয়সে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া আবদুল মোনেমের নিজের নামে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানের ছাতার নিচে রয়েছে ডজনের বেশি কোম্পানি, যিনি এসএসসি পাসের সনদ নিয়ে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি নির্মাণ ব্যবসা শুরু করা সেই মানুষটি শুধু দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নন, বাংলাদেশের নির্মাণশিল্পের পথিকৃৎ।
এম এ হাসেম : খ্যাতনামা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য এম এ হাসেম ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে না-ফেরার দেশে চলে যাওয়া ৭৭ বছর বয়সী এম এ হাসেম সফল উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। কর্মসংস্থান ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে তাঁর অবদান এ প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে বাঁচিয়ে রাখবে।
লতিফুর রহমান : বরেণ্য ব্যবসায়ী ও ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান ১ জুলাই কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। ৭৫ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী ১৯৭২ সালে প্রায় শূন্য হাতে ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা, সুনাম আর সততার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১২ সালে তিনি পান বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড, যা ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে নোবেল বলে খ্যাত। লতিফুর রহমান এ দেশে গণমাধ্যম ব্যবসায়ও বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। দাদা ও বাবা ব্যবসায়ী হলেও নিজে ব্যবসা শুরু করেছিলেন ব্যাংক ঋণ নিয়ে।
নুরুল ইসলাম বাবুল : দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপরিবার যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বাবুল ১৩ জুলাই না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। ৭৪ বছর বয়সী এই শিল্পোদ্যোক্তা আজীবন অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন সাহসী ও প্রতিবাদী। মেধাবী এই ব্যবসায়ী ১৯৭৪ সালে যমুনা গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। মেধা, দক্ষতা, পরিশ্রম ও সাহসিকতার মাধ্যমে একে একে শিল্প এবং সেবা খাতে গড়ে তোলেন ৪১টি প্রতিষ্ঠান। একজন দূরদর্শী, দেশপ্রেমিক ও আধুনিক চিন্তার সাহসী উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর সুনাম রয়েছে।
ইমামুল কবির শান্ত : করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৩০ মে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস ও শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ইমামুল কবির শান্ত। ৬৬ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস ছাড়াও শান্তনিবাস, শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন।
আজমত মঈন : দেশের চা-শিল্পের খ্যাতিমান ব্যবসায়ী-শিল্পপতি আজমত মঈন করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৭ জুন না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। ৬৮ বছর বয়সী এই শিল্পোদ্যোক্তা মৌলভী চা কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং সুরমা চা কোম্পানির পরিচালক ছিলেন। তিনি অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নবাব মোশাররফ হোসেনের প্রপৌত্র।
মোরশেদুল আলম : করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোরশেদুল আলম ২২ মে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। ৬৫ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের বড় ভাই। তিনি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের পরিচালকও।
শেখ মোমিন উদ্দিন : করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অন্যতম বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আকিজ উদ্দিনের মেজো ছেলে ও আদ্্-দ্বীন ফাউন্ডেশনের পরিচালক শেখ মোমিন উদ্দিন মারা যান ২৪ আগস্ট। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। এ ছাড়া বিদায়ী বছরে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সেলিম। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৭ সেপ্টেম্বর মারা গেছেন চট্টগ্রামের শিল্পপতি হাসান মাহমুদ চৌধুরী। তিনি লাতিন আমেরিকা-বাংলাদেশ চেম্বারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও থাই চেম্বারের পরিচালক ছিলেন। ময়নামতি টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শিল্পপতি হাসান জামিল সাত্তার ২৫ জুন মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। পপুলার হাসপাতালের চেয়ারপারসন তাহেরা খানম মারা যান ১০ জুন। করোনা পজিটিভ থাকাকালে ঢাকার অন্য একটি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
বিদায়ী বছরে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ, রহমত গ্রুপের চেয়ারম্যান আলহাজ মোহাম্মদ আলী সরকার, এনএফকে টেক্সটাইলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান, পার্ল প্রিনস বিডি লিমিটেডের চেয়ারম্যান তসলিম আক্তার ও অ্যাপারেল ফেয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন মাহমুদ। এ ছাড়া বাংলাদেশ হোটেল অ্যান্ড গেস্টহাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সাদিক আহসান, বাংলাদেশ প্লাস্টিক রাবার শু মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হাজি মো. মনসুর আলী, বাংলাদেশ পেপার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি সিরাজ উদ্দিন দেওয়ান, বাংলাদেশ পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি হাজী নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ড্রেস মেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাজি মো. আবদুল কালাম আজাদ, বাংলাদেশ রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি আবু বকর সিদ্দিক, বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শের মোহাম্মদ, ন্যাশনাল কোল্ডস্টোরেজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. কামরুল হুসেন চৌধুরী গোর্কি, বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান, বাংলাদেশ মেটাল ওয়্যার অ্যান্ড ওয়্যারনেইলস মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মো. মোবারক হোসেন, রয়েল ট্রেডিং করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী বদরুল হুদা মুকুল, এফবিসিসিআইর সদস্য মো. হাবিবুল্লাহ ও বাংলাদেশ পোদ্দার সমিতির সভাপতি মো. বাচ্চু মিঞাও এ করোনাকালে মারা গেছেন।
=বাংলাদেশ প্রতিদিন=