আজ জাতীয় ভোটার দিবস
কোনো ব্যক্তি, প্রার্থী বা দল যদি ভোটের মাঠে অন্যায়ভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে বা ভোটে অনিয়ম করে তবে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাসহ প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা আইনে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) দেওয়া আছে। এমনকি কোনো কর্মকর্তা যদি ভোটে অনিয়মে সহযোগিতা করেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পারে ইসি। কিন্তু গত দুটি জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে অনিয়মের নানা ঘটনা দেখা গেলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কমিশন তার ক্ষমতা প্রয়োগে নীরব থেকেছে। ইসির এমন ভূমিকায় মানুষের ভোটাধিকার প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ভোটের প্রতিও আগ্রহ কমছে মানুষের। নির্বাচন বিশ্লেষকেরা বলছেন, কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো মানুষের আস্থার সংকট কাটিয়ে ভোটাধিকার রক্ষা করা।
এমন পরিস্থিতিতে আজ ২ মার্চ দেশে চতুর্থবারের মতো পালিত হতে যাচ্ছে ‘জাতীয় ভোটার দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, রক্ষা করব ভোটাধিকার’।
নির্বাচন বিশ্লেষকেরা বলছেন, আস্থার যে সংকট তৈরি হয়েছে, নতুন ইসিকে তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা কাটিয়ে উঠতে হবে। সংবিধানে ইসিকে স্বাধীন সত্তা ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে তারা জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা করতে পারে, জনগণ নিজের পছন্দ অনুযায়ী ভোট দিতে পারে। আর এটি নিশ্চিত করা ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব। তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই অধিকার রক্ষায় সরকারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গত দুটি জাতীয় নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক ভোটারের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন এবং ২০১৮ সালে রাতের ভোট ও নানা কারসাজির কারণে অনেক ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সাংবিধানিকভাবে ভোটাধিকার রক্ষা করা ইসির দায়িত্ব। কিন্তু এখানে নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। সরকারে সহায়তা না থাকলে ইসির পক্ষে ভোটাধিকার রক্ষা করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে ইসির হাতে ভোট বাতিল বা বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা আছে। তারা ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে না পারলেও ভোটাধিকার হরণ প্রতিহত করতে পারে।
নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেও প্রথম সংবাদ সম্মেলনে এসে গত সোমবার বলেছেন, সংবিধান ও আইন অনুসরণ করে তাঁরা চেষ্টা করবেন, যাতে সবাই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, এটাই তাঁদের বড় চ্যালেঞ্জ।
ইসি সচিবালয় সূত্র জানায়, গত ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ভোটারসংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৩১ লাখ ২৩ হাজার ১৭৫। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬৮ হাজার ৮০৭ জন। নারী ভোটার ৫ কোটি ৫৫ লাখ ৫৩ হাজার ৯২৭ জন। আর হিজড়া পরিচয়ে ভোটার আছেন ৪১১ জন। এর বাইরে ১১ লাখ ১৪ হাজারের বেশি নতুন ভোটারের আবেদন ঝুলে (পেন্ডিং) আছে।
ভোটাধিকার রক্ষার জন্য ভোটের মাঠে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, এই কাজটি করতে হবে ইসিকে। তবে নতুন সিইসি বলেছেন, ইসির একার পক্ষে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। একটি সুষ্ঠু ভোটের জন্য তিনি রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। অতীত অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান বাস্তবতায় দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা হবে, এমনটা আশা করা কঠিন। সংবিধান ও আইনে ইসিকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারলে সমান সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।
জাতীয় নির্বাচন–সম্পর্কিত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা হয়েছে, যদি নির্বাচন কমিশন সন্তুষ্ট হয় যে, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে ইসি সক্ষম হবে না, তাহলে যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা সম্পূর্ণ নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে বন্ধ করতে পারে ইসি।
কিন্তু সর্বশেষ দুটি নির্বাচন কমিশনকে এসব ক্ষমতা তেমন একটা প্রয়োগ করতে দেখা যায়নি। বিএনপি জোটের বর্জনে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল একতরফা। ১৫৩টি আসনে ভোটেরই প্রয়োজন হয়নি। ফলে দেশের অর্ধেকের বেশি ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগই পাননি। বাকি যে ১৪৭টি আসেন ভোট হয়েছিল সেখানেও ছিল জাল ভোটসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ। এই ভোট করে ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়েছিল কাজী রকিবউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন।
আর কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দল থাকলেও ভোটের মাঠে সবার জন্য সমান সুযোগ ছিল না। প্রচারে বাধা, ভোটের আগের রাতে ভোট দিয়ে বাক্স ভরে রাখা, নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ ছিল। কিন্তু ইসি ভোটের আগে ও পরে কোনো অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে আমলে নেয়নি। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোয়ও ইসির শক্ত অবস্থান দেখা যায়নি।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নতুন সিইসি বলছেন, তাঁদের একার পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব না, তা হয়তো ঠিক। তবে এ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে সংবিধান ও আইনে নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট।
তথ্যঃ প্রথম আলো