বলিউডে দিলীপ কুমার, টলিউডে উত্তম কুমার চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি আর গর্ব। আমাদের আছে চলচ্চিত্রের অবিসংবাদিত রাজা নায়করাজ রাজ্জাক। টানা পাঁচ দশক দক্ষ কর্মযজ্ঞ দিয়ে দেশীয় চলচ্চিত্রের ভাণ্ডারকে পূর্ণতা দিয়েছেন তিনি। পেয়েছেন মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা।
রাষ্ট্রও তাকে দিয়েছে কাজের স্বীকৃতি ও যথাযথ সম্মান। চলচ্চিত্রের এই মহান রাজা পেয়ে গেছেন একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, জাতীয় পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পদক।
গত বছরের ২১ আগস্ট কোটি ভক্তকে চোখের জলে ভাসিয়ে পরপারে চলে গেছেন চলচ্চিত্রের এই রাজাধিরাজ। বেদনা নিয়ে আজ তার মহাপ্রয়াণের এক বছর পূর্ণ হলো। তার স্মৃতির প্রতি রইল বাংলাদেশ প্রতিদিন পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধা।
১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতায় জন্ম নেওয়া আবদুর রাজ্জাক স্কুল জীবনেই অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬৪ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে স্ত্রী খায়রুন নেসা লক্ষ্মী আর তিন মাস বয়সের পুত্র বাপ্পারাজকে নিয়ে একজন শরণার্থী হিসেবে ঢাকায় আসেন রাজ্জাক। শুরু হয় তার জীবনযুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে জয়ী হতে চলচ্চিত্রকেই বেছে নেন তিনি। কাজের প্রতি আন্তরিকতা আর মমত্ববোধ সহজেই তাকে সহকারী পরিচালক আর সহশিল্পী থেকে রাজার আসনে বসিয়ে দেয়।
১৯৬৮ সালে নায়ক হিসেবে তার প্রথম ছবি জহির রায়হান নির্মিত ‘বেহুলা’ মুক্তি পায়। তার অভিনয় কুশলতায় চারদিকে তখন সাজ সাজ রব। পাঁচ দশক ধরে নিরবছিন্নভাবে একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে চলচ্চিত্রে পথচলা নায়করাজের। ‘বেহুলা’ ছবিতে তার বিপরীতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুচন্দা।
সুচন্দা বলেন, ‘কাজের প্রতি নিষ্ঠা একজন সাধারণ মানুষকে যে অসাধারণ করে তুলতে পারে তার প্রমাণ রাজ্জাক। তিনি যথার্থ চলচ্চিত্রের রাজা। পৃথিবীতে নায়করাজ একজনই হয়েছেন, দ্বিতীয় কেউ আর হতে পারবে না।’ চলচ্চিত্রের রাজা হয়েও নায়করাজের মধ্যে অহংবোধ ছিল না। অহংকারকে তিনি কখনো পছন্দ করতেন না।
নায়করাজের কথায় প্রতিষ্ঠা আর ভালোবাসা পেতে হলে বিনয়ী হতে হয়। সত্যিই তিনি অসাধারণ একজন বিনয়ী মানুষ ছিলেন। তার কথাবার্তা আর আচার-আচরণে সদা এই বিনয়ী ভাব ফুটে উঠত। কাউকে কষ্ট দিয়ে তিনি কথা বলেছেন এমন কথা কখনো শোনা যায়নি। প্রয়াণের আগে মিডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার মহানুভবতার কথাই আবার ফুটে উঠেছিল।
সাক্ষাৎকারে নায়করাজ বলেছিলেন, এই জীবনে আমার আর চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই, সৃষ্টিকর্তা আমাকে সম্মান, ভালোবাসা এবং সুন্দর একটি সংসার দিয়েছেন। আমার জীবন সুখের পূর্ণতায় ভরা। এখন সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সম্মান নিয়ে তার কাছে ফিরে যেতে পারলেই এ জীবন সার্থক হবে।
তিনি বলেছিলেন, আমি জীবনটাকে সহজভাবেই উপভোগ করি। আমি মানুষ রাজ্জাক, এটাই আমার বড় পরিচয়। যখন অভিনয় করি তখন শিল্পী। এর বাইরে সাধারণ মানুষ। আমি কখনো কারও সঙ্গে অহংকার দেখাইনি। একটি বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি।
নিজের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন সম্পর্কে নায়করাজের কথা ছিল-জীবনে সফলতার জন্য অনেক ধৈর্য আর ত্যাগের দরকার। কেউ যখন কোনো একটা অবস্থানে চলে যায়, তখন নিজেকে মানিয়ে চলতে খুব কম মানুষই পারে। সৃষ্টিকর্তা আমাকে সহযোগিতা করেছেন।
ব্যক্তিগত ভালোবাসা ও প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির কারণেই চলচ্চিত্রে এসেছিলাম। প্রতিষ্ঠাও পেয়েছি। আমি মনে করি, ব্যক্তি রাজ্জাক একবারেই সাধারণ। আর শিল্পী রাজ্জাক মানে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের পাত্র। যারা সময়টাকে জয় করতে পারে, তারা জীবনে অনেক কিছুই করতে পারে। আমার স্বপ্ন ছিল, যে করেই হোক আমাকে শিল্পী হতে হবে। তার জন্য যতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তা আমি করব। এ ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা ও দর্শক আমাকে সহযোগিতা করেছেন। যে কোনো মানুষের জীবনে একটা স্বপ্ন থাকতে হয়।
আমি কী হতে চাই? দোটানা থাকা যাবে না, আত্মপ্রত্যয়ী হতে হবে। অবশ্যই সেটা বাস্তবতার আলোকে হতে হবে। নিজের অবসর জীবন সম্পর্কে নায়করাজ বলেছিলেন, একটা সময় ‘দিন-রাত’, এই শব্দ দুটো জীবন থেকে মুছে ফেলেছিলাম। সেই সময়গুলোকে এখন খুব মনে পড়ে। অভিনয়ে ব্যস্ত না থাকার যন্ত্রণাটা যে কি, সেটি শুধু একজন শিল্পীই অনুধাবণ করতে পারে। এখন বয়স হয়েছে।
তারপরও মন চায় অভিনয়ে আগের মতো ব্যস্ত থাকতে। কিন্তু শরীর তো সায় দেন না। জীবনের গতিতে জীবন চলে যাচ্ছে। জীবন তো অনেক সুন্দর। মৃত্যুকে নিয়ে চলচ্চিত্রের এই শক্তিমান রাজার সাহসী জবাব ছিল— ‘এখন কী আর মৃত্যুকে ভয় করার সময় আছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে তো একদিন ফিরে যেতেই হয়। এটিই পৃথিবীর অমোঘ নিয়ম।
শেষ ইচ্ছের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত নায়করাজ বলেছিলেন, না, শেষ ইচ্ছা বলে তেমন কিছু নেই, সুন্দরভাবে জীবন পার করে দিচ্ছি। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে। নায়করাজের আত্মতৃপ্তির কথা শুনে তারই নির্মিত ও অভিনীত ‘বাবা কেন চাকর’ ছবির একটি গানের কথা মনে পড়ে গেল—‘আমার মতো এত সুখী নয়তো কারও জীবন, কী আদর স্নেহ-ভালোবাসায় জড়ানো মায়ার বাঁধন...’।