বৃষ্টি হচ্ছে মন খারাপ। কিংবা আকাশে গাঢ় মেঘ। ভালো লাগছে না কিছুই। উল্টোও হয়। চারপাশে গুমোট ভাব। এক পশলা বৃষ্টি হলে ভালো লাগত বেশ। তাই মন খারাপ।
এই মন খারাপের বিষয়টি প্রথম প্রথম বেশ রোমান্টিক। বন্ধু বা বান্ধবীর সঙ্গে দেখা নেই। কথা হচ্ছে না। কথা দিয়েও টিএসসিতে বা বটতলায় আসেনি, তাই মন খারাপ। মনের কষ্ট বিষণ্নতায় গড়ালে তখন তা ক্রমেই রূপ নেয় মনোরোগে। বিষণ্নতা কিন্তু মনের অসুখ। হেলাফেলার নয়।
মানুষের মন বড়ই বিচিত্র। সে যা চায় তা পায় না আর যা পায় তা চায় না। আর তাই তার অবিশ্রান্ত ছুটে চলা। চলতে গেলে হোঁচট খেতে হয়। তারপর গা-ঝাড়া দিয়ে মানুষ উঠে দাঁড়ায়। টানাপোড়েন মনের ওপর কখনো কখনো প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি করে। সেই চাপের মোকাবিলা করতে না পারলে মন খারাপ হয়। কখনো তীব্রতা বেড়ে গিয়ে মানুষ মানসিক বিপর্যয়ে ভোগে। বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়, আত্মহত্যা করে বসে।
মন খারাপ কেন হয়?
মানুষের মস্তিষ্ক মন নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার যেমন সিরোটনিন ডোপামিন নরএড্রেনালিন গাবা গ্লুটামেটের মাত্রার ব্যতিক্রম হলে মনের স্বাভাবিকতার ওপর প্রভাব পড়ে। মনের দোলাচল বেড়ে যায়। আর এদের মাত্রা ভারসাম্য না থাকার পেছনে আমাদের খাদ্যাভ্যাস জীবনাচরণও অনেকখানি দায়ী।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনের চাহিদা, মানসিক চাপ পরিবর্তিত হতে থাকে। শরীরে হরমোনের ওঠানামাও ঘটতে থাকে। কৈশোরে ও ৪৫ বছরের পর থেকে শরীরে হরমোনের পরিবর্তন বেশি হয়। গর্ভধারণের সময় ও বাচ্চা প্রসব পরবর্তী সময়ও হরমোনের পরিবর্তন দেখা যায়। আর এসবই মনের ওপর প্রভাব ফেলে।
আবহাওয়ার পরিবর্তনও মানুষের মনকে আনমনা করে দেয়। শীতকালে সূর্যের আলো কমে গেলে সেটা কারও কারও মনকে অজান্তেই বিষণ্ন করে তুলতে পারে। সূর্যের অতিরিক্ত তাতানো গরম মানুষের মনকে তেমন তাতিয়ে তুলতেও পারে।
একাকিত্ব মানুষের মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। এ জন্য শেষ বয়সে সবাই যেন তাকে ঘিরে থাকে এই চাওয়াটা তার কাছে অনেক বড় হয়ে ওঠে। ছোটবেলার বেড়ে ওঠার সময় বিভিন্ন ইতিবাচক ঘটনা মানুষের মনে লেপ্টে থাকে। যখন সুযোগ পায় সেটা মনকে বিষণ্ন করে তুলতে দেরি করে না।
মানুষের চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই। আর সেটার ঘাটতি হলেই মন খারাপ হয়। মানসিক চাপ ধকল সহ্য করতে না পারলে সবারই খারাপ লাগে। এখনকার জীবনটা কেমন যুদ্ধ যুদ্ধ মনে হয়। এই বুঝি হেরে গেলাম। সারাক্ষণ প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে সবাই এগিয়ে যাচ্ছে।
মন খারাপের কিছু লক্ষ্মণ :
এবার মন খারাপের কিছু প্রচলিত লক্ষ্মণের কথা বলব। পাশাপাশি এসব একদম পাত্তায় না নেওয়ার পরামর্শও আগাম দিয়ে রাখছি।
* দুঃখ দুঃখ ভাব, একাকিত্ব; সবকিছু শূন্য মনে হওয়া।
* কাজকর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
* ক্লান্ত ও নিজেকে শক্তিহীন মনে হওয়া।
* পরিষ্কার চিন্তা করতে না পারা।
* সিদ্ধান্ত নিতে দেরি ও অনীহা। মনে পড়ছে না, এমন অলস ভাবনা।
* নিজেকে মূল্যহীন, গুরুত্বহীন মনে হওয়া। রাগ উদ্বেগ দুশ্চিন্তা। অস্থিরতা, অতি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়া।
* খিদে না লাগা, ঘুম না হওয়া। কোনো বিষয়ে নিজেকে দোষী মনে হওয়া।
* নিজের প্রতি রাগ হওয়া।
এখন যা করবেন :
* জীবনের সুখময় স্মৃতি রোমন্থন করবেন। ইতিবাচক স্মৃতি কার জীবনে নেই? একে ঝেড়ে ফেলুন।
* জীবনকে নতুন করে সাজাবেন। নতুন কোনো গঠনমূলক চিন্তাভাবনা করবেন।
* আপনার পরিচিত পরিবেশকে নতুন করে সাজিয়ে তুলুন। নতুবা নতুন পরিবেশে নিজেকে জুড়ে নিন। দেখবেন, নতুন ভাবনা নতুন চিন্তা আপনাকে কর্মঠ করে তুলছে।
* সব সময় আনন্দময় বা আনন্দ পাওয়ার মতো কিছু করুন। কৌতুকে অনেকের বেশ আগ্রহ। এ সংক্রান্ত সাহিত্য বাংলা ভাষায় খুবই সমৃদ্ধ। তারাপদ রায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী পড়তে পারেন। ভালো লাগবে। পড়া বা নাচ-গান করা বা শোনা, হাসির নাটক ও সিনেমা দেখা, টিভিতে জিওগ্রাফি চ্যানেলও দেখতে পারেন। অনেকের আনন্দ সিরিয়াস বিষয় পাঠে বা সিরিয়াস নাটক চলচ্চিত্র দেখায়। তাও মন্দ কি।
* ভ্রমণে আগ্রহী হলে বাইরে বেড়াতে যান। কাছে-দূরে। সমুদ্রের তীরে, বনের ধারে বা পাহাড়ের চূড়ায় কোনো রিসোর্টে, নিজের গ্রামের বাড়িতে, ধানখেতের কাছে। যেখানে ইচ্ছা। কোনো মানা নেই। মন ভালো তো জগৎ ভালো।
* আপনার কোনো শখ থাকলে সেটা সাধ্যের মধ্যে মেটানোর চেষ্টা করুন।
* ঘরের আশপাশে জায়গা থাকলে বাগান করুন। এখন শহরে জায়গার অভাবে ছাদেও বাগান করে মানুষ নির্মল আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।
* যে ঘটনা আপনার মনকে ভারী করে, বিষণ্ন করে, সেসব মনের পাতায় না আনলেই তো হয়। ওসব নিয়ে অত ভাবার কী দরকার। অপ্রয়োজনীয় চিন্তা একদম ঝেড়ে ফেলুন।
* আপনাকে যে পছন্দ করে, আপনারও যাকে পছন্দ, তার সঙ্গে থাকুন। তাকে গুরুত্ব দিন।
* যাকে আপনার পছন্দ নয়, যারা আপনাকে এড়িয়ে চলে, অপছন্দ করে, তাদের পাত্তা না দিলে কি আসে-যায় তেমন? সবাই আপনাকে ভালোবাসবে, সে হয় না।
* মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে সারা জীবন দৌড়ে বেড়ায়। মন খারাপ হলে তখন ঘর ছাড়া আর কোথাও জায়গা হয় না। পরিবার সদস্যদের অনাত্মীয় মনে হয়। তাই সময় থাকতেই পরিবারকে সময় দিন। অহেতুক আড্ডা না দিয়ে পরিবার, শুভার্থীদের সময় দিন। সত্যিকারের বন্ধু খুঁজে নিন। তাদের সঙ্গে সময় কাটান। সব সময় সুস্থ এবং ইতিবাচক আচরণের মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করবেন।
* ভবিষ্যতের দিকে তাকান। আজকের দিনটাই সব নয়। সামনের পথ কেমন হবে, এখন থেকেই পরিকল্পনা করুন। ভবিষ্যৎ-জীবনে পরনির্ভরশীল না হয়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পরিকল্পনা মাথায় নিন।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা শুভশক্তি বা ইতিবাচক মনোভাব সবার মধ্যেই থাকে। এই শক্তি সব সময় সঞ্চয় করে রাখতে হবে। মন থাকবে ভরপুর ও ফুর্তিময়।
বিশ্বের তাবৎ বড় বড় মনোরোগবিদের কথা একটাই: মন তোমারই। মনকে নিয়ন্ত্রণ করো। মনকে সাজাও। রাঙাও। মনকে কখনোই ভেঙে পড়তে দিয়ো না। এ জন্য মনের উদ্যম, আপন শক্তি প্রথম ভরসা। সবচেয়ে বড় ভরসাও।
মনোবিদ এমি মারলোর সরস কথা হলো: মন হাতের মুঠোয় রাখো। হাতছাড়া কোরো না। কাউকে পছন্দের যা ইচ্ছে দাও। কিন্তু সাবধান, নিজের মনটা উপড়ে নিয়ে কাউকে দিতে যেও না। প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা সময় নিজের জন্য রাখা। নিজেকে একান্ত সময় দেওয়া। নিজেকে বোঝার চেষ্টা করা।
লেখক জে কে রাউলিং বলছেন, ‘মন মনের জায়গায় না থাকলে মুশকিল। নিজেকে না জানলে মন খারাপ বা বিষণ্নতাকে কখনোই সামলানো যাবে না। নিজেকে উপলব্ধির চেষ্টার চেয়ে বড় প্রতিষেধক কিছু নয়।
খাওয়াদাওয়ায় যত্ন নিন:
নিজেকে সুস্থ রাখতে হাসিখুশি থাকতে নিয়মিত খাওয়াদাওয়া ও পর্যাপ্ত ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। খেতে হবে সিরোটনিনসমৃদ্ধ খাবার, যা আপনার উদ্বিগ্নতা কমাবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে। বাড়াবে আপনার স্মরণশক্তি। পর্যাপ্ত ঘুম নিয়মিত ব্যায়াম আপনাকে দেবে নতুন কর্মোদ্যম। দিনের বেলা প্রয়োজনে একটু দিবানিদ্রা দিয়ে নিলে মন সতেজ হয়ে যায়। শরীরও ঝরঝরে হয়। তাই অতিরিক্ত চা, কফি, মাদকাসক্তি থেকে নিজেকে দূরে রাখাটা খুবই জরুরি।
আরেকটি কথা :
ক্ষমা করতে শিখুন। দেখবেন মনটা অনেক বড় হয়ে যাবে। আর সঙ্গে কৃতজ্ঞতাবোধ যেন থাকে। তাহলে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে। দৃষ্টি প্রসারিত হবে। কাজের পরিসর বাড়বে।
মন খারাপ অতিরিক্ত হলে, নিজের িনয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে, বিষণ্নতা রোগ বা ডিপ্রেশনের সৃষ্টি হতে পারে। আর তার জন্য চাই প্রয়োজনীয় মনোচিকিৎসা। দেরি না করে তখন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ ও কনসালট্যান্ট, ওসিডি ক্লিনিক ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা