রাজধানীর অভিজাত এলাকার ক্লাব ও বিভিন্ন বাসাবাড়িতে রাত গভীর হলেই বসছে কোটি কোটি টাকার জুয়ার আসর। ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, নয় তাস, কাটাকাটি, নিপুণ, চড়াচড়ি, ডায়েস, চরকি রেমিসহ নানা নামের জুয়ার লোভ সামলাতে না পেরে অনেকেই পথে বসছেন। এতে পারিবারিক অশান্তিসহ সামাজিক নানা অসঙ্গতি বাড়ছে। ভুক্তভোগীরা সর্বস্বান্ত হলেও জুয়ার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আয়োজক চক্র। অথচ আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু লোককে ম্যানেজ করেই দিনের পর দিন চলছে এসব কর্মকাণ্ড।
সূত্র মতে, শুধু ঢাকার পাশে মেলা ও রাজধানীর ক্লাব নয়, জুয়ার আসর বসছে এখন যত্রতত্র। ঢাকার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লাতেও বসছে জুয়ার আসর। পাড়া-মহল্লার জুয়ার আসরগুলোতেও লাখ লাখ টাকার জুয়া খেলা হয়। প্রভাবশালী মহলের শেল্টারে রাজধানীতেই অন্তত দেড় শ জুয়ার স্পট চলছে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা এসব জুয়ার আসর খোলা থাকে। পাহারায় নিয়োজিত নিজস্ব অস্ত্রধারী টিম। এদের আইনি ঝামেলা থেকে সুরক্ষা দেয় খোদ পুলিশ প্রশাসনেরই কিছু অসাধু কর্মকর্তা। একজন উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, একেকটি স্পটে প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৩ কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়। সে হিসাবে রাজধানীর জুয়ার স্পটগুলোতে দৈনিক ৩০০ কোটি টাকা উড়ছে। এ টাকার একটি বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে চলে যায় বিদেশে। জানা গেছে, জুয়ার এসব আসর টিকিয়ে রাখতে গত পাঁচ বছরে উচ্চ আদালতে অসংখ্য রিট হয়েছে। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের এক আইনজীবী জানান, সংবিধানে জুয়া খেলা নিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে রাষ্ট্রকে বলা হয়েছে। রাষ্ট্রের কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ দায়িত্বশীল কেউই জুয়া খেলা অব্যাহত রাখার পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। অনুসন্ধানে জানা যায়, অভিজাত ক্লাবগুলোতে রাতভর চলা জুয়ার আড্ডায় উড়ছে কোটি কোটি টাকা। পেশাদার জুয়াড়িরা এসব ক্লাব-গেস্ট হাউসের জুয়া পরিচালনা করলেও নেপথ্যের শেল্টারদাতা হিসেবে থাকেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী কেউ না কেউ। রাজধানীর মতিঝিল-আরামবাগে খেলাধুলা চর্চার জন্য গড়ে ওঠা নামিদামি ক্লাবগুলো বাস্তবে পরিণত হয়েছে জুয়ার আস্তানায়। এক সময়ের মতিঝিলের ক্লাবপাড়ার ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলোও জুয়ার বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। এসব ক্লাবে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার জুয়া খেলা হচ্ছে। গভীর রাতে ক্লাবগুলোতে আসতে শুরু করে বিত্তবানদের গাড়ি। তাদের সঙ্গে থাকে ঢাকাই সিনেমার উঠতি নায়িকা থেকে শুরু করে নামি-দামি মডেল। এসব মডেল-অভিনেত্রী জুয়ার আস্তানায় স্কর্ট গার্ল হিসেবে পরিচিত।
সূত্র জানায়, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এ সর্বগ্রাসী জুয়ার আস্তানা এখন ছড়িয়ে পড়ছে আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানীর অলি-গলিতেও। ক্লাবের বাইরে বিভিন্ন এলাকার গেস্ট হাউস ও ফ্লাট বাসায়ও এ ধরনের আয়োজন করা হয়। বাদ পড়ছে না বস্তি এলাকাও। নিকেতন, নিকুঞ্জ, উত্তরা, রূপনগর, খিলগাঁও, লালবাগ, হাজারীবাগ, বাড্ডার অসংখ্য বাসায় নিয়মিত জুয়ার আসর বসানো হয়। এসব আসরে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে ছিনতাইকারী, ছিঁচকে চোর, পকেটমার, মলমপার্টির সদস্য এমন কি দিনমজুররাও অংশ নেয়। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার কারবার হয় এসব আসরে। যাত্রাবাড়ী পাইকারি বাজারে মত্স্য আড়তের বটতলায় কয়েকটি কক্ষে দিন-রাত তিন তাস, কাইট, হাজারি ও কেরাম বোর্ডে জুয়া চলে। এখানকার দুটি স্পটে চলছে জুয়া। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পোস্তগোলা থেকে পাগলা পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের অফিসগুলোতে রাত-দিন জুয়া চলে। এ ছাড়া বড়ইতলা থেকে জুরাইন রেলগেইট পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে কমপক্ষে দুই হাজার কেরাম বোর্ডে জুয়া চলে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। মিরপুরের ২ নং সেকশন, শাহআলী মাজার, গাবতলীর মাজার রোড, কল্যাণপুর বস্তি, মিরপুর ১০ নং সেকশনের ফুলবাগান ক্লাব, ১১ নং সেকশনে নির্মাণাধীন সিটি করপোরেশন মার্কেটের পেছনে ফকিরপট্টি এবং ৬ নং সেকশনে চলন্তিকা ক্লাবে নিয়মিত জুয়ার আসর বসে। এসব আসরে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার কারবার চলে। এসব আসরের আয়োজকদের বেশিরভাগই পেশাদার জুয়াড়ি। ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে তারা হাতেগোনা কয়েকজনকে নিয়েই বাসাবাড়িতে জুয়ার আসর বসাচ্ছেন। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হওয়ায় জুয়াড়িরাও এখন ফ্ল্যাট বাসার প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন।
দেশেই চলছে ক্যাসিনো : এখন আর ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা সিঙ্গাপুরে নয়, ক্যাসিনো জুয়ার আসর বসছে খোদ ঢাকাতেই। উত্তরা অভিজাত এলাকায় জুয়ার বোর্ড বসিয়ে নেপালী প্রতারক চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। উত্তরার একটি অভিজাত ক্লাবে নেপালিসহ কয়েকজন বিদেশি নারী-পুরুষের সহযোগিতায় চালানো হচ্ছে অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্য। উত্তরার পাশাপাশি দক্ষিণখানে, আশকোনাতেও রয়েছে ক্যাসিনো।
রমরমা জুয়া রূপনগর-উত্তরায় : রাজধানীতে মতিঝিল ক্লাবপাড়ার বাইরে রূপনগর ও উত্তরা থানায় সবচেয়ে বেশি জুয়ার আসর চলে বলে জানা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ দুটি থানা এলাকা রীতিমতো জুয়ায় ভাসছে। প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় আবাসিক হোটেল, বিভিন্ন মেস, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও বহুসংখ্যক আবাসিক বাড়ির ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে বসানো হচ্ছে জুয়ার বোর্ড। থানার নামে সপ্তাহে ৩০ হাজার টাকা বখরা দেওয়ার চুক্তিতে রূপনগর থানা এলাকায় ১৬টি জুয়ার রমরমা আসর চলছে। একেকটি জুয়া স্পটে প্রতিদিন ২০ লাখ থেকে কোটি টাকার জুয়া খেলা চলে। জুয়ার আসরগুলো থেকে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা, মাস্তান, কমিউনিটি পুলিশের ইউনিট, ভুয়া সাংবাদিক, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পিএস-এপিএসদের নাম লিখে দৈনিক বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দেওয়া হচ্ছে। জুয়াড়িরা খেলতে আসা লোকদের কাছ থেকে কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। জুয়া খেলতে গিয়ে অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানরাও জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ভুক্তভোগী পরিবারসহ এলাকার মানুষজন। তাদের অভিযোগ, পুলিশ জুয়া খেলা, অসামাজিক কর্মকাণ্ড ও মাদক ব্যবসা বন্ধের পরিবর্তে এসব অপরাধের মদদদাতা হিসেবে কাজ করছে।