২০০৪ সালের ১২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ। নারী (১৯৯২), দ্বিতীয় লিঙ্গ (২০০১) ও পাক সার জমিন সাদ বাদ (২০০৪) তাঁর আলোচিত গ্রন্থ। হুমায়ুন আজাদের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬০টির বেশি। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান তিনি। এ ছাড়া ২০১২ সালে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয় তাঁকে। বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ এই লেখকের নানা দিক নিয়ে এনটিভি অনলাইনকে একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাঁরই বড় মেয়ে মৌলি আজাদ।
প্রশ্ন : বাবার মৃত্যু দিনটিকে কীভাবে স্মরণ করেন?
মৌলি আজাদ : তিনি সব সময় আমাদের প্রার্থনায় আছেন। পারিবারিকভাবে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করছি না।
প্রশ্ন : বাবার লেখালেখির মধ্য দিয়ে কি বাবাকে খোঁজা হয়?
মৌলি আজাদ : ‘তখনো আমার সময় আসেনি। আমি যে পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাইনি। তখনো আমার সময় আসেনি। আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।’ নিজের সম্পর্কে এতটা সত্য উপলব্ধি কয়জন করতে পারে বলুন? বাবার এই কবিতার মাঝে তাঁকে যেন আমি খুঁজে পাই।
প্রশ্ন : বাবার কোন সাহিত্যকর্মটি আপনার প্রিয়?
মৌলি আজাদ : তাঁর লেখা শিশুসাহিত্য। সত্যি বলতে কি, আমি গ্রাম, গ্রামের প্রকৃতি, সৌন্দর্য সবকিছুই চিনেছি তাঁর বই পড়ে। তাঁর লেখা ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ আমার সবচেয়ে প্রিয় বই। এই বইটির পাতা উল্টালেই আমার মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। তিনি বইয়ের শুরুতে লিখেছেন, ‘মৌলি তোমাকে বলি তোমার মতই আমি একসময় ছিলাম—ছোট। ছিলাম গ্রামে, গাঁয়ে, যেখানে মেঘ নামে সবুজ হয়ে, নীল হয়ে, লম্বা হয়ে বাঁকা হয়ে। শাপলা ফোটে; আর রাতে চাঁদ ওঠে শাদা বেলুনের মতো। ওড়ে খেজুর ডালের অনেক ওপরে। যেখানে এপাশে পুকুর ওপাশে ঘরবাড়ি। একটু দূরে মাঠে ধান সবুজ ঘাস কুমড়োর হলদে ফুল। একটা খাল পুকুর থেকে বের হয়ে পুঁটি মাছের লাফ আর খলশের ঝাঁক নিয়ে চলে গেছে বিলের দিকে। তার ওপর একটা কাঁঠের সাঁকো- নড়োবড়ো। নিচে সাঁকোর টলোমলো ছায়া। তার নাম গ্রাম।’ আজও চাঁদের দিকে তাকালে আমার কেবল শাদা বেলুনের কথা মনে হয়। মনে হয় চাঁদ নয় বেলুন দেখছি। তাঁর লিখিত ‘লাল নীল দীপাবলী’ বইটিও আমার অতি প্রিয় একটি বই।
প্রশ্ন : যখন বাবার কোন লেখা নিয়ে বিতর্ক হতো তখন আপনিও কি সেই বিতর্কে মতামত রাখতেন?
মৌলি আজাদ : না। আমার মনে হতো সময়ের জন্য তাঁর লেখাগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিতর্ক বরং বাবাকে আলোচনার কেন্দ্রে আনত বলে আমার মনে হতো।
প্রশ্ন : আপনার বাবা কি কোনো লেখা নিয়ে আপনাদের সঙ্গে লেখার আগে আলাপ করতেন? বা পরে?
মৌলি আজাদ : কখনো আগে নয়। তবে বইমেলায় বই বের হওয়ার পর তিনি আমাদের সবাইকে তাঁর লেখা বই অটোগ্রাফসহ উপহার দিতেন। কিছুদিন পর জিজেস করতেন বইটি পড়েছি কি না? তখন তাঁর সঙ্গে তাঁর বই নিয়ে আলোচনা হতো।
প্রশ্ন : বাবার কোন বিষয়টি সবচেয়ে ভালো লাগত?
মৌলি আজাদ : সবকিছু তুচ্ছ করার একটা সাহস ছিল তাঁর মধ্যে। যা আমি আজ আর কারো মধ্যে দেখি না।
প্রশ্ন : লেখক হুমায়ুন আজাদ বাবা হিসেবে কেমন ছিলেন? পরিবারে সময় দিতেন নাকি লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন?
মৌলি আজাদ : লেখালেখি আর পড়াশোনা ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। তাই বলে পরিবারকে ফাঁকি দিয়ে নয়। আমাদের পড়াশোনার বিষয়টি তিনিই দেখভাল করতেন। মা চাকরি করতেন বিধায় তিনিই বাজার করতেন। সর্বোপরি বাবা হিসেবে তিনি ছিলেন দায়িত্বশীল।
প্রশ্ন : বাবা হিসেবে ও পাঠকের দৃষ্টিতে একজন লেখক হিসেবে তাঁকে মূল্যায়ন করুন।
মৌলি আজাদ : মেয়ে হিসেবে তাঁর কাছে আমি আজন্ম কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে আমার কাজ ও চিন্তার স্বাধীনতা পুরোপুরিভাবে দিয়েছিলেন। আর তাই আজও আমি আমার জীবনের সকল সিদ্ধান্ত নিজেই নিই, যা আমার বয়সী অনেকেই নিতে পারে না। পাঠকের দৃষ্টিতে যদি তাঁকে মূল্যায়ন করি তবে বলব, তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে সাহসী লেখক। জানি না, আরেকজন সাহসী হুমায়ুন আজাদের আবির্ভাব আবার কবে হবে বাংলা সাহিত্যে। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে জানাই শ্রদ্ধা।