রাষ্ট্রপতি মো. অবদুল হামিদ বলেছেন, ‘দেশ ও জাতির উন্নয়নে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিকল্প নেই। গণতন্ত্র ও উন্নয়ন একে অপরের পরিপূরক। একটি ছাড়া অপরটি অচল। তাই গণতন্ত্রের ভীতকে মজবুত করতে হলে দেশে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। আর সেই নেতৃত্ব তৈরি হবে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের কোন স্থান থাকবে না। ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব থাকবে ছাত্রদের হাতে। লেজুড়বৃত্তি বা পরনির্ভরতার কোন জায়গা থাকবে না। ছাত্রসমাজকেই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।’
শনিবার বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তীব্র প্রতিযোগিতাময় এ বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে বিশ্বমানের গুণগত শিক্ষা ও গবেষণার বিকল্প নেই। তাই বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম হাল নাগাদ করতে হবে। উচ্চশিক্ষা যাতে সার্টিফিকেট সর্বস্ব না হয় কিংবা শিক্ষা যাতে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত না হয় তা দেশ ও জাতির স্বার্থে সম্মিলিতভাবে নিশ্চিত করতে হবে। এটা করতে না পারলে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়বে এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়বো। যুগের চাহিদাকে ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানাই।’
তিনি বলেন, ‘আজকাল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অসহিষ্ণুতা, উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদের মতো নৈতিবাচক কর্মকাণ্ড জাতি গভীর উদ্বেগের সাথে প্রত্যক্ষ করছে। আমি মনে করি এর উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে, মুক্তচিন্তা ও সংস্কৃতি চর্চার অভাবে। জাতির অমিত শক্তি যুব সমাজ। যুব সমাজের শক্তি ও সম্ভবনাকে দেশ গঠনের কাজে লাগাতে হবে। আমাদের যুব সমাজকে অবশ্যই অপসংস্কৃতির প্রভাব মুক্ত হয়ে স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হতে হবে।’
গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘তোমাদের আজকের এ অবস্থানের জন্য তোমাদের পিতা-মাতা, শিক্ষক, সমাজ, দেশ ও জনগণের বিপুল অবদান রয়েছে। তোমরা এসবের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে মেধা, প্রজ্ঞা ও কর্ম দিয়ে জাতির আশা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। নৈতিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ও বিবেক জাগ্রত রাখবে। অন্যায় ও অসত্যের কাছে মাথানত করবে না। মনে রাখতে হবে সমাবর্তন শিক্ষার সমাপ্তি ঘোষণা করছে না, বরং উচ্চতর জ্ঞানভাণ্ডারে প্রবেশের দ্বার উন্মোচন করছে।’
১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অধ্যাপক ড. হবিবুর রহমান, ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মীর আবদুল কাইউমসহ মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারীদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর অনেক জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ওইসব আলোকিত গুণীব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে তরুণ শিক্ষার্থীরা যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে- এ বিশ্বাস আমার আছে।
রাজশাহীর সঙ্গে নিজের অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ‘রাজশাহীর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি-ইতিহাস রয়েছে। এখানে জাতীয় নেতা শহীদ এইএএচএম কামারুজ্জামান হেনার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তিনি মেঘালয়ে আমার সঙ্গে ৫-৬ দিন ছিলেন। আমার অনেককিছু মনে পড়ে। মেঘালয়ে আমরা যখন যুদ্ধের বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন করছিলাম তখন প্রায়ই আমাদের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হতো। একটি ছোট কক্ষে সিঙ্গেল বেডে দু’জনকে আড়াআড়ি করে থাকতে হতো। আমি কিছুটা চিকন ছিলাম, হেনা ভাই মোটাসোটা ছিলেন। আমরা ঘুমলেই ২-৩ মিনিট পর হেনা ভাই এমন নাক ডাকা শুরু করতেন তখন আর ঘুমের কাছে যাওয়া সম্ভব হতো না। তিনি ঘুমে নড়াচড়া করলে প্রায় বিছানা থেকে ফ্লোরে পড়ে যেতাম।
তিনি আরও বলেন, আমি যখন ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠি রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় আমার বাবা খুব বকাঝকা করেছিলেন। পরে রাগ করে সারা বাংলাদেশ টিকেট ছাড়া ঘুরেছি। রাজশাহীতেও আমি এসেছিলাম। তখন রাজশাহীতে ঘোড়ার গাড়িকে টমটম বলতো। ওই টমটমে চড়ে আমি রাজশাহী এসে দু’দিন থেকে যাই। সামরিক শাসনামলে রাজবন্দী হিসাবে রাজশাহী জেলে বন্দী থাকার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, রাজশাহীতে আরেকবার আসা হয়েছিলো ১৯৭৬ সালে আমি যখন জেলে ছিলাম। আমাকে ময়মনসিংহ জেল থেকে ট্রান্সফার করে কুষ্টিয়া ও সেখান থেকে রাজশাহী জেলে ট্রান্সফার করা হয়। তখন আমি ৭ মাস জেলে ছিলাম। রাজশাহীর পদ্মার পাড়ের যতো বালি আছে তার অর্ধেক জেলের বিছানায় পড়তো। ঘুমানোর সময় বিছানা পরিষ্কার করে ঘুমাতে হতো।
সমাবর্তন বক্তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এমিরেটাস অধ্যাপক আলমগীর মো. সিরাজউদ্দীন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক পরিবেশ সম্পূর্ণ সুস্থ এবং আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে না এমন দাবি করি না। শিক্ষকদের পাঠদানে অবহেলা, যথাসময়ে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে না পারা কিংবা পক্ষপাতমূলক ও অবাঞ্ছিত আচরণের অভিযোগ শোনা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক প্রতিবেদনে ক্যাম্পাসের শিক্ষক ও ছাত্রদের দলীয় রাজনীতির অকল্যাণকর প্রভাব, সেশনজট সংস্কৃতির কারণে শিক্ষা জগতে নৈরাজ্য, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাজে ও চিন্তায় স্বচ্ছতায় ও জবাবদিহিতার অভাব উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের বাধা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু উচ্চশিক্ষার মানের অবনতি হয়নি, পরীক্ষা পদ্ধতিও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। অবস্থা এমন যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক অন্যের মূল্যায়নের উপর আস্থা রাখতে চায় না।’
সমাবর্তনে ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি, এমবিবিএস, বিডিএস ডিগ্রি অর্জনকারী নিবন্ধিত ৬ হাজার ১৪ জন গ্র্যাজুয়েটকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আনুষ্ঠানিকভাবে ডিগ্রী প্রদান করেন।
এছাড়া বাংলা সাহিত্যে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক এবং সেলিনা হোসেনের হাতে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার (ডি. লিট) ডিগ্রি তুলে দেন রাষ্ট্রপতি। পরে সন্ধ্যায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন।
এর আগে বিকেল সাড়ে ৩টায় রাষ্ট্রপতি হেলিকপ্টার-যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নবাব আব্দুল লতিফ হলের মাঠে পৌঁছেন। নেমেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে বিশ্রাম নেন। সেখানে রাষ্ট্রপতিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা ও গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এরপর বিকাল ৪টার দিকে রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য ১০ তলা বিশিষ্ট ‘দেশরত্ন শেখ হাসিনা হল’ এবং ছাত্রদের জন্য ১০ তলা বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ‘শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান হল’ এর ভিত্তিপ্রস্তরের ফলক উন্মোচন করেন।
এরপর তিনি সমাবর্তনস্থল বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়ামে পৌঁছান। এ সময় উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহান, শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ ও রাজশাহী সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনসহ স্থানীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানান।