একটা কথা চালু আছে, ‘খেয়েই মরেছে বাঙালি’। বাঙালির খাওয়ার অভ্যাসে কত ঘাটের জলই না এসে মিশেছে! আর সেসব খাবার নিয়ে বিলাসিতার শেষ নেই বাঙালির। এই যে বাঙালির তেজহীন শরীরে আলসেমি নিয়ে ঢিলেঢালা চলাফেরা আর শারীরিক ভাষার পেছনে যে তার খাদ্যাভাস লুকিয়ে রয়েছে এ তো সবার মুখে মুখে ফেরে।
বাঙালির কাছে খাবার যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়। এই যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ অনুষ্ঠিত হলো গত বৃহস্পতিবার। রাজনৈতিক এমন কঠিন সময়ের মাঝেও কে খেল আর কে খেল না, কী খাবার পরিবেশন করা হলো— এ নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। ফেসবুকের নিউজ ফিড জুড়ে ছিল গণভবনের সংলাপের সময় পরিবেশিত খাবারের মেন্যু।বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বেশ খাদ্যরসিক ছিলেন। তিনিও তার বিভিন্ন লেখায় জানিয়ে দিয়েছিলেন ‘তেজোহানিকর ধান্য’ই উদ্যমী আর্যদের অলস করেছিল। সেই আর্যতান্ত্রিক আলসেমির সন্তানদল আধুনিক বাঙালি নানাভাবে তার মাশুল দিচ্ছে। এই ছিল বঙ্কিমের উপলব্দি। গৃহসুখপরায়ণ, দিবানিদ্রায় আগ্রহী, উদ্যমহীন ভাতখেকো বাঙালির জীবনে পরাধীনতা যেন অনিবার্য। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ধর্মীয় বাছবিচারও তাদের কম ছিল না, এখনও তা একেবারে উবে যায়নি। স্বামী বিবেকানন্দও কী খাবেন আর কী খাবেন না তা নিয়ে কম ফিরিস্তি দেননি।
এমনিতে বাঙালির শরীরে ছত্রিশ জাতের রক্ত মিলে-মিশে আছে। রান্নার রকমসকম তাই এক নয়। ঘটি-বাঙালের আলাদা, আলাদা হিন্দু-মুসলমানের, শাক্ত-বৈষ্ণবেও যে কত ভেদ-বিভেদ। নানা গোষ্ঠীর নানা রান্না, নানা বাসন, নানা আসন। পারস্য, পতুর্গিজ, বিলিতি, চীনা, দিশি কত ঘাটের রান্নার স্রোত এসে মিলেছে বাঙালির পাতে। খাওয়া-দাওয়া তাই বঙ্গ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
বাঙালির খাবার মানেই ভাতের সঙ্গে শাক, ডাল, মাছ। সেই আদিকাল থেকেই তো তাই। এই তো মাত্র সাতশ’ বছর আগে ‘প্রাকৃতপৈঙ্গলে’ অজ্ঞাতনামা এক কবি লিখেছিলেন—‘ওগগরভত্তা রম্ভঅপত্তা, গাইকঘিত্তা দুদ্ধসজুতা।/ মোইণিমচ্ছা ণালিচগচ্ছা, দিজ্জই কন্তা খা পুণবন্তা।’ অর্থাত্ ‘কলার পাতায় ঢালা ফেনসহ গরম ভাত, কিছু গাওয়া ঘি, গরম দুধ, ময়না মাছ, নালিতা শাক (পাট শাক) স্ত্রী পরিবেশন করছে, পুণ্যবান খাচ্ছে।’ বাঙালির খাবার মানে তো এই। কিন্তু সেই বাঙালির পাত এখন শুধু মাছে ভাতে থেমে নেই। সেই পাতে উঠে এসেছে মোঘলদের মেন্যু, পর্তুগিজ, ইংরেজ ও চীনাদের খাবার।
খাল-বিল-নদী-নালার দেশ বঙ্গদেশে আগাগোড়াই মাছ খাওয়া হতো বলে ধরে নেয়া হয়। অষ্টম শতাব্দী থেকে পাহাড়পুর এবং ময়নামতিতে যেসব পোড়ামাটির ফলক দেখা যায়, তার অনেকগুলোতেই মাছের ছবি আছে। তবে প্রাচীন বাঙালি সমাজে মাছ খাওয়াটা অব্রাহ্মণদের মাঝেই সীমিত ছিল। ৮ম থেকে ১২শ’ শতকে পাল ও সেন রাজাদের অধীনে থাকার সময় মানুষের খাদ্যাভ্যাস ছিল ভিন্ন। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাবে ভাত ও নিরামিষ প্রাধান্য পেত। ধীরে ধীরে মাছ ও দুধ অন্তর্ভুক্ত হয়।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সুফি-দরবেশদের প্রভাব দেখা দেয় বাংলায়। এরা এসেছিলেন মধ্য এশিয়া, আরব, পারস্য থেকে। আরব বণিকদের মাধ্যমে তারা পূর্ব ভারতীয় মশলার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এই আরব বণিকদের মাধ্যমেই বঙ্গোপসাগর ও ঢাকার নদীবন্দরে এসব মশলা আসত। সুলতানি আমলে মশলার দ্বীপ মালাক্কার সাথে সুলতানদের যোগাযোগ হয়। এসময় পর্তুগিজ বণিকদের সহযোগিতায় বাংলার বণিকরা মালাক্কা, সুমাত্রা ও জাভার মশলা ঢাকায় নিয়ে আসত।
বাঙালির পাতে পর্তুগিজ রেসিপি:শুকনো মরিচ আর সরিষার তেলে মাখানো আলু ভর্তার যে ঝাঁঝালো স্বাদে বাঙালির চোখ আর জিভের জল এক হয়ে যায়, সে মরিচ আর আলুর আদি নিবাস যে বাংলাদেশেই নয়। বাঙালির পাতে এটা এসেছে পর্তুগিজদের হাত ধরে। সে কথা জানা আছে আপনার! ১৬শ’ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ১৭শ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত পর্তুগিজরা বাংলার রাষ্ট্রীয় সকল কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। ইউরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকার অনেক ফলমূল ও শুকনো খাবার এদেশে নিয়ে এসেছিল তারা। বাঙালিদের রান্নার এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য ঝাল। অথচ সে ঝালের সাথে বাঙালিদের পরিচয় করালো বহিরাগত পর্তুগীজরা। তাদের মরিচ ভারতবর্ষের লোকেরা লুফে নিয়েছিল। পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ভারতবর্ষে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ঝাল মরিচ। পেঁয়াজ ও রসুন আগে থেকেই বঙ্গের মাটিতে হতো নাকি মুসলিম শাসকেরা আমদানি করেছিলেন তা সঠিক জানা যায়নি। কিন্তু তা খাওয়ার রীতি যে মুসলিমরাই চালু করেছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সে সময় পিঁয়াজ, রসুনের প্রতি হিন্দু সমাজের যে আপত্তি ছিল তা এখনো অনেক জায়গায় বহাল আছে। পূজার খাবার তৈরি করতে এখনও পিঁয়াজ ব্যবহার হয় না। পাউরুটি পর্তুগীজদের আমদানি বলে মনে করা হয়। পাঁউ পর্তুগীজ শব্দ, ইংরেজি নয়। বিস্কিটও তারাই এনেছিলেন ধরা হয়। এখন পাউরুটি, বিস্কুট ছাড়া অনেকেরই সকাল-বিকেলের নাশতা পূর্ণ হয় না অথচ তখন এই খাবার দুটির প্রতি দেশীয়দের বিদ্বেষ ছিল অত্যন্ত প্রবল। হিন্দুরা এ দুই খাবারকে ধর্মনাশক বলে বিবেচনা করতেন, কারণ এসব তৈরি হতো বিদেশি এবং মুসলিম বাবুর্চির হাতে। পর্তুগীজ ‘আনানাস’ই বাংলায় অধিক রসের জন্য আনারস নামে পরিচিত হয়ে যায়। আতা, কাজুবাদাম, সফেদাও পর্তুগীজরাই নিয়ে আসেন।
আলু, টমেটো কিংবা কাঁচামরিচ ছাড়া কি বাঙালি কোনো খাবারের পদ কল্পনা করা যায়। ভাতের সঙ্গে তারকারির অন্যতম উপাদান এ সবজিগুলো। মাছের ঝোলে আলুর সঙ্গে টমেটো কিংবা মসলাদার মাংসে সাদা গোল আলু ছাড়া খাবারের মজা ঠিক জমে না। পর্তুগিজরাই এসব উপকরণের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়েছে বাঙালিদের। এছাড়া নান জাতের ফল আর সবজির মধ্যে ঢেঁড়স, মিষ্টি আলু, বেগুন, পেয়ারা আর পেঁপের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় পর্তুগিজদের হাত ধরে।
বাঙালি হিন্দুদের খাবার পাতে একটু শুক্তো না হলে চলে না। মুলা, মটরশুঁটি, করলার সঙ্গে আলু দিয়ে চচ্চড়ি রান্নার ধারণাও নাকি পর্তুগিজদের। বাঙালি রান্নায় পর্তুগিজ প্রভাব এমনই নিবিড়। এত গেল তরকারি। মিষ্টি থেকে চাটনি তৈরিতেও বাঙালিকে প্রভাবিত করেছে পর্তুগিজরা। আপেল, আম কিংবা আনারস দিয়ে যেমন জেলি তৈরি করা হয় তেমনি খাবার হিসেবে টমেটোর চাটনির জনপ্রিয়তা রয়েছে এ অঞ্চলে। কেবল খাবার নয়, পর্তুগিজদের কাছ থেকে খাবার সংরক্ষণের বিভিন্ন কৌশলও আয়ত্ত করেছে বাঙালি। বিশেষ করে আচার সংরক্ষণ পদ্ধতিগুলো। ফলে বাঙালি খাবারে পর্তুগিজ প্রভাব গভীর ও স্থায়ী। আর বাংলায় দুধ থেকে ছানা ও দই প্রস্তুতের কৌশলটিও শিখিয়েছে ওই পর্তুগিজরাই। যা কিনা এখন বাংলার মিষ্টি হিসেবেই সবাই জানে, চেনে।
বাঙালির রসু্ইঘরে মোঘল মেন্যু:নবাবী সংস্কৃতি ও সুখাদ্যের শহর বলতে প্রথমেই যে নামটি আসে তা হলো উত্তর ভারতের অযোধ্যার লখনৌ। এখানকার নবাবরা মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর ভারতের রান্নার সঙ্গে মোঘল রান্নার রন্ধনশৈলী মিলিয়ে নতুন নতুন খাবার সৃষ্টি করেছিলেন। এর পাশাপাশি কাশ্মীরি, পাঞ্জাবি ও হায়দ্রাবাদের নবাবদের হাত ধরে কাবাব, কোরমা, কালিয়া, বিরিয়ানি, শিরমাল, নেহারি, তাফতান রুটি, রুমালি রুটি, বাকরখানি, জর্দা, লাসসি, শরবতের নানা প্রকারভেদ যেমন সৃষ্টি হয় তেমনি নতুন নতুন মেন্যুও উঠে আসে। শুধু খাবার কেন পান সাজানো ও পানের উপাদানেও মোঘল প্রভাব রয়েছে।
‘ঢাকাই খাবার ও খাদ্য সংস্কৃতি’ বইয়ে লেখক সাদ উর রহমান বলছেন, ‘মোঘল ও ব্রিটিশ আমলে নবাবদের খাদ্য বিলাসিতা ও শখ দেখে বাবুর্চিরা নতুন নতুন রান্না সৃষ্টি করতেন।’ এক বাবুর্চি বানিয়েছিলেন আনার দানার পোলাও। যার প্রতিটি দানা অর্ধেক সাদা, অর্ধেক লাল আর কাচের মতো ঝকঝকে। আরেকজনের আবিষ্কার নবরতন পোলাও। যা নয়টা রঙের চাল দিয়ে তৈরি। অযোধ্যার নবাব আবুল কাশেম খান ছিলেন সৌখিন স্বভাবের মানুষ। তার বাড়িতে খুব মসলাদার পোলাও রান্না হতো।
মুসলিমদের হাত ধরে মধ্যযুগে বাঙালি সমাজের একটি অংশে নতুন ধরনের খাবারের রীতি চালু হয়। খুব ধীরে হলেও খাবারের অভ্যাসে বদল ঘটতে শুরু করে। উপমহাদেশের বাইরে থেকে আসা বাদশা, নবাব, আমীররা পারস্য এবং পশ্চিম ও কেন্দ্রীয় এশিয়া থেকে রান্নার ঐতিহ্য নিয়ে এসেছিল। ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসে তুর্কি মোঘলদের আধিপত্য। তুর্কিরাই দিল্লিতে সুলতানশাহি প্রতিষ্ঠার মূলে ছিলেন। ১৫২৬ সালে মোগল যুগের সূচনার আগে বাবরের পূর্ব পুরুষ তৈমুর ছিলেন বরলাস নামের মোঙ্গল গোত্রের মানুষ। তাদের আদিবাস ছিল বর্তমানের দক্ষিণ কাজাখিস্তানে। কালক্রমে মোঘলরা তুর্কিদের সঙ্গে মিশে যান। চেঙ্গিস খান মুসলমান ছিলেন না। মুসলমান হয়েছেন অনেক পরে। মুসলমান হওয়ার পরে তুর্কি ও মোঘলরা উন্নত ইরানি বা পারস্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসেন। এতে ভারতে মোঘল বাদশাহদের মধ্যে পারসিক সভ্যতার প্রভাব ছিল বেশি। যা তাদের খাবার রান্না ও তা পরিবেশনের রীতিতে দেখা যায়।
গোলাম মুরশিদের ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, মোঘলদের এসব রান্না কখন যে বৃহত্তর বাঙালি সমাজে স্থান করে নিয়েছে তা ঠিকঠাক জানা যায় না। গোলাম হোসেন সালিমের গ্রন্থ ‘রিয়াজ-উস-সালাতীন’ বইয়ে উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘এ দেশের উঁচু-নিচু সবাই মাছ, ভাত, সর্ষের তেল, দই, ফল আর মিঠাই খেতে পছন্দ করে। প্রচুর লাল মরিচ এবং লবণ তাদের পছন্দ। তারা আদৌ গম এবং যমের রুটি খায় না। ঘিয়ের রান্না খাসি এবং মোরগের মাংস তাদের মোটেই সহ্য হয় না।’
মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল, বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল আর নারায়ণ দেবের পদ্মাপুরাণ থেকে ইঙ্গিত মেলে মুসলিমরা মাংস খেত। আর মোরগ জবাই করে মোল্লারা পয়সা পেত। এসব লেখা থেকে ইংরেজ আমল শুরুর আগ পর্যন্ত বাঙালিরা যেসব খাবার খেত তার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখান থেকে জানা যায়, বাঙালি পরিবারগুলোতে শাক, মাছ ও সবজি ও মিষ্টি খাওয়ার প্রচলন ছিল। ঊনিশ শতকের শুরুতে ঈশ্বর গুপ্তের লেখায় হিন্দু বাড়িতেও পোলাও যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল সে বর্ণনা পাওয়া যায়।
ঢাকায় মোঘলদের খাবার:ঢাকার নবাবরা এসেছিলেন ভারতের কাশ্মির থেকে। কাশ্মিরী নবাবী রান্নার সঙ্গে স্থানীয় রান্নার বিভিন্ন উপকরণের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তারা খাবার বৈচিত্র্যময় করে তুলেছিলেন। এসব বাদশাহী ও নবাবী খাবার দীর্ঘদিনের অভ্যাসে ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। যা এখন ঢাকাই খাবার নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘ঢাকাই খাবার’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, নবাবদের রসুইঘরে বাবুর্চিদের মাধ্যমে মোঘলদের এসব খাবারের বিস্তৃতি ঘটে। খাবার তৈরির দিক থেকে ঢাকার বর্তমান বাবুর্চিরা মোঘল আমলের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। ঢাকার জনপ্রিয় বেশিরভাগ খাবার এসেছে মোঘলদের রেসিপি থেকে। এই বাবুর্চিদের হাত ধরে সাধারণের মাঝে ছড়িয়েছে। তবে এসব খাবার জনপ্রিয়তা পেয়েছে ইংরেজ আমলের শেষ দিকে।
রেস্টুরেন্ট সংস্কৃতি:ইংরেজ ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে আঠারো শতক থেকে বাংলায় প্রথমবারের মতো রেস্টুরেন্ট খোলা হয়। ইংরেজ আমলের অনেক নিষিদ্ধ খাবার এবং পরিবারের ভেতরে অপ্রচলিত অনেক খাবারই তরুণেরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেতেন। ১৮৪০ এর দশকে রাজনারায়ণ বসু গরুর মাংসের কাবাব এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত মাংস, প্যাটিস আর বিস্কিট কিনে খাবার কথা তাদের নিজেদের লেখার ভেতরেই উল্লেখ করেছেন। এভাবেই বাঙালি সমাজে একটা রেস্টুরেন্ট কালচারের সূচনা হয়ে যায়। প্রথম দিকে এসব রেস্টুরেন্টে ইংরেজ বাবুর্চিরা হেঁশেল সামলালেও, পরে মুসলিম বাবুর্চিরা যুক্ত হন। এদের মধ্যেই কেউ কেউ যখন নিজেদের রেস্টুরেন্ট খোলেন তখন সেখানে ইংরেজ খাবারের বদলে মোগলাই খাবার চালু করেন। ঊনিশ শতকের বাঙালি সমাজে তখন ঐতিহ্যবাহী নানা খাবারের পাশাপাশি কোর্মা, কাবাব, বিরিয়ানির মতো বিভিন্ন মুসলিম খাবার জনপ্রিয় হতে শুরু করে। বিশ শতকে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাঝে এসব মোগলাই খাবার দারুণভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কেক, প্যাটিস, পাউরুটি, চপ, কাটলেট এসব আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে হালকা খাবার হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে।
তবে দেশ বিভাগের আগে কলকাতায় এবং পরে বাংলার অন্যত্র চীনা রেস্টুরেন্ট চালু হয়েছিল। এসব চীনা রেস্টুরেন্টের খাবারের স্বাদ চীনা হোক বা না হোক, বিভিন্ন উপলক্ষে সেখানে খেতে বা খাওয়াতে পারাটা এক রকম গর্বের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো বাঙালিদের কাছে। এসব চাইনিজ রেস্টুরেন্টকে কেন্দ্র করেই চীনা ও থাই খাবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বাঙালিদের মাঝে। এছাড়া দক্ষিণ চীনা ও ম্যাকাও রন্ধনশৈলীর বেকিং, গ্রিলিং ও রোস্টিংও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বাঙালিদের মাঝে।
আবার সত্তর ও আশির দশকে উচ্চশিক্ষা বৃত্তি নিয়ে যারা বিভিন্ন দেশে পড়তে গিয়েছিলেন, তারা এবং তাদের ছেলেমেয়েরা দেশে ফিরে সেসব খাবারের সন্ধান করতে থাকে। সেই চাহিদা থেকে এদেশেও পশ্চিমা খাবারের দোকানগুলো একরকম প্রসার লাভ করতে শুরু করে। আমাদের দেশে বার্গার, হটডগ ইত্যাদি ফাস্টফুডের শুরুটা এভাবেই। এখন তো তরুণ ও কিশোরদের কাছে রেস্টুরেন্ট কালচার খুব জনপ্রিয়।