তসলিমা নাসরিন
সারা মুসলিম বিশ্ব কেঁপে উঠেছে নিউজিল্যান্ডের মসজিদে সন্ত্রাসী ঘটনার খবর শুনে। মুসলিমদের ওপর মানুষের এমনিতে অনেক রাগ, কারণ মুসলিমরা বিশ্ব জুড়ে ভয়ংকর ভয়ংকর সন্ত্রাসি কান্ড ঘটায়। শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটে, শত শত মেয়েরা ধর্ষিতা হয়। সে কারণে কিছু মুসলিম বিদ্বেষী লোক সুযোগ পেলে মুসলমানদের অপমান, নির্যাতন করতে ছাড়ে না। মসজিদে সন্ত্রাসী আক্রমণ মুসলিমদের প্রতি সেই ঘৃণারই বহিঃপ্রকাশ।
মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা নতুন কিছু নয়। সুন্নী সন্ত্রাসীরা শিয়াদের মসজিদে, বা আহমদিয়াদের মসজিদে প্রায়ই হামলা চালায়। মুসলিম বিদ্বেষীরা ভেবে নিয়েছে সব মুসলিমই সন্ত্রাসী, সুতরাং একটি মুসলিমকে হত্যা করা মানে একটি সন্ত্রাসীকে হত্যা করা। অধিকাংশ নিরীহ নিরপরাধ মুসলিমকে শাস্তি পেতে হয় অল্প সংখ্যক মুসলিমদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য।
মানবতা ভূলুন্ঠিত হয়েছে বলে মুসলিমরা যেভাবে একজোট হয়ে হাহাকার করছে, ঠিক সেভাবেই কেন তারা হাহাকার করে না যখন মুসলিম সন্ত্রাসীদের হাতে অমুসলিমরা বা ইসলামে অবিশ্বাসীরা মরে? তাহলে কি এটাই ঠিক যে মুসলিমরা মারা গেলে তারা যতটা দুঃখ পায়, অমুসলিমরা মারা গেলে ততটা পায় না? মুসলিম বিদ্বেষীদের দেখেছি, মুসলিম মরলে ওরা দুঃখ তো পায়ই না, বরং খুশি হয়। এ অনেকটা আবার তেমনই হয়ে গেল না তো।
শুধু আমার পরিবারের বা আমার সম্প্রদায়ের লোক মরলে আমি কাঁদবো, অন্য কেউ মরলে আমার কিছু যায় আসে না, এ কোনও ভালো মানুষের কথা নয়।
মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা পেতে হলে মুসলিমদের শুধু 'সন্ত্রাসী নই', এই ট্যাগই যথেষ্ট নয়। মুসলিমদের প্রতি যেমন, অমুসলিমদের প্রতিও তাদের সমান সহমর্মী হতে হবে।
মুসলিমরা অমুসলিমদের দেশে যতটা স্বাধীনতা , সহযোগিতা, পায়, ততটা কোনও মুসলিম দেশ থেকে পায় না। তাই যত ধর্মান্ধই হোক, তারা অমুসলিমদের দেশে বাস করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
সারা পৃথিবীর অমুসলিম লোক যেভাবে নিরীহ মুসলমানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছে, যেভাবে এগিয়ে এসে সাহায্য করছে, মুসলিমদেরও এ থেকে শেখা উচিত। অমুসলিমদের নৃশংস মৃত্যু হলে মুসলিমদেরও এভাবে শোক প্রকাশ করা উচিত।
যারা মুসলানদের সন্ত্রাসী হওয়ার পেছনে আমেরিকা আর ইজরাইলএর কার্যকলাপকে দোষ দেয়, তারা কি এখন মসজিদে ঢুকে মুসলানদের হত্যা করার পেছনে, আইসিসদের বা বোকো হারামদের কার্যকলাপকে দোষ দেয়? যদি না দেয়, তাহলে কোথাও কোনও গন্ডগোল আছে।
মুসলিমদের শুধু শিশু হলে চলবে, এবার সময় হয়েছে প্রাপ্ত বয়স্কের মতো আচরণ করার। দায়িত্ববান হওয়ার। 'আমার ধর্ম নিয়ে কথা বলা চলবে না, আমার পোশাক নিয়ে কথা বলা চলবে না, আমার অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া চলবে না, আমার নবীকে আঁকা চলবে না, তাহলে মেরে ফেলবো, আগুন জ্বালিয়ে দেবো..... শিশুর মতো আবদার সব! সভ্য হতে চাইলে শুধু নিজের নয়, পৃথিবীর সবার-- সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব লিংগের, সব ভাষার মানুষের মানবাধিকারে, এবং গণতান্ত্রিক অধিকারে বিশ্বাস করতে হবে। [লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া]