গেল ১০ বছর ধরে ফুটবল-রাজত্বের রাজদণ্ড হাতবদল হচ্ছে শুধু লিওনেল মেসি ও ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর মধ্যে। এর অর্ধেক সময়ে, অর্থাৎ সর্বশেষ পাঁচ বছর ধরেই বিশ্বের ‘তৃতীয় সেরা খেলোয়াড়’ হয়ে আছেন নেইমার। এই বিশ্বকাপটা তাঁর জন্য ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসনে আরোহণের উপলক্ষ। পরশু একই দিনে মেসি-রোনালদোর বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আরো বেশি করে। কিন্তু গ্রুপ পর্বের তিন খেলায় যে অমন কিছু করতে পারেননি নেইমার। কিলিয়ান এমবাপ্পে যেমনটা করেছেন আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। নিদেনপক্ষে সতীর্থ ফিলিপে কৌতিনিয়োর মতোও তো নয়!
এতে ব্রাজিলিয়ান ক্যাম্পে খানিক দুশ্চিন্তা রয়েছে সত্যি। আবার ইতিহাসে কান পাতলে প্রেরণাও তো রয়েছে। ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী পাঁচ দলের প্রতিটিতেই তো অমন জোড়ায় জোড়ায় গলা জড়াজড়ি করে এসেছে সাফল্য। এখন কৌতিনিয়ো সঙ্গে নেইমারও যদি জ্বলে উঠতে পারেন আজ থেকে, তাহলে এই ব্রাজিলকে ঠেকায় কে!
১৯৫৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সেই অমর জুটি পেলে-গারিঞ্চা। দুজনের প্রতিভা সম্পর্কে কোচ ভিসেন্তে ফিওলার সংশয় ছিল না বিন্দুমাত্র। ব্রাজিল দলের মনোবিদ যখন বলেন, বিশ্বকাপের বিশ্বমঞ্চে খেলার জন্য ১৭ বছরের পেলে বড্ড অপরিণত, জবাব দেন ব্রাজিল কোচ, ‘তা হয়তো ঠিক। কিন্তু আপনি তো ফুটবলের কিছু জানেন না। আর আমি পেলেকে খেলতে দেখেছি।’ তাঁর সংশয় ছিল পেলে-গারিঞ্চাকে একসঙ্গে খেলানো নিয়ে। তবু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মিউনিখ ট্র্যাজেডিতে বিধ্বস্ত ইংল্যান্ডের সঙ্গে যখন ১-১ গোলে ড্র করে সেলেসাওরা, দুজনকে একসঙ্গে নামিয়ে দেন কোচ। ব্রাজিলের জয়রথ আর থামানো যায়নি। গারিঞ্চা আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত; সঙ্গে বিশ্বমঞ্চে নিজের প্রতিভার ভেঁপু বাজিয়ে দেন পেলে। কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনের বিপক্ষে জয়সূচক গোলে; সেমিফাইনালে জ্যাঁ ফতে, রেমন্ড কোপার ফ্রান্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে আর ফাইনালে সুইডেনের বিপক্ষে জোড়া গোলে। পেলে-গারিঞ্চা একসঙ্গে খেলেছেন, এমন কোনো ম্যাচ কখনোই হারেনি ব্রাজিল।
তবে ’৬২-র শিরোপাজয়ে এই জুটি নয়, বড় অবদান গারিঞ্চা-আমারিলদো জুটির। ইনজুরির কারণে স্পেনের বিপক্ষে খেলতে পারেননি পেলে। তাতে জোড়া গোল আমারিলদোর। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে গারিঞ্চার গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। বিরতির আগে সমতায় ফেরে ইংলিশরা। দ্বিতীয়ার্ধে গারিঞ্চার ফ্রি-কিকের শটে বল পোস্টে লেগে ফেরত এলে তা জালে পাঠিয়ে ভাভা এগিয়ে নেন ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের। খানিক পর পেনাল্টি এরিয়ার ঠিক বাইরে বল পান গারিঞ্চা। এরপর তাঁর বিখ্যাত ‘ব্যানানা শট’-এ বলের আশ্রয় জালে। ৩-১ গোলে জিতে ব্রাজিল উঠে যায় সেমিফাইনালে। আর ব্রিটিশ গণমাধ্যম অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছে, ‘স্ট্যানলি ম্যাথুস, টম ফিনি এবং একজন সাপুড়ের মিশেল যেন গারিঞ্চা।’ সেমিতে চিলির বিপক্ষে ৪-২ গোলের জয়েও তাঁর দুই গোল। প্রথমটি ২০ গজ দূর থেকে বাঁ পায়ের শটে, পরেরটি হেডে। চিলির সংবাদপত্র ‘এল মারকুরিও’ এবার শিরোনাম করে, ‘কোন গ্রহ থেকে গারিঞ্চা এসেছে?’ ফাইনালেও দুর্দান্ত খেলেন তিনি; আর পেলের বিকল্প হিসেবে খেলা আমারিলদো করেন প্রথম গোল; পরেরটি তাঁর পাস থেকে।
১৯৭০ বিশ্বকাপে তারায় তারায় খচিত দল ব্রাজিলের। সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা নিঃসন্দেহে পেলে। ছিলেন রিভেলিনো, তোস্তাও, গেরসনরা। তবে গোল করায় সবচেয়ে ধারাবাহিক জেয়ারজিনহো। বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচে গোল করা একমাত্র খেলোয়াড় তিনি। সেবার ফাইনালে ইতালিকে ৪-১ গোলে হারিয়ে জুলে রিমে ট্রফির সোনালি পরি চিরতরে জিতে নেয় ব্রাজিল। সেরা খেলোয়াড়ের গোল্ডেন বল জেতেন পেলে। আর আজতেকার ওই ফাইনালে পেলের পাহারায় থাকা ইতালিয়ান ডিফেন্ডার তারচিজিয়ো বুর্গনিচের কথাটি শুনুন, ‘খেলা শুরুর আগে নিজেকে বলি, অন্য সবার মতো পেলেও তো হাড়-চামড়ায় তৈরি। কিন্তু পরে বুঝেছি, আমার বোঝা ভুল ছিল।’
এরপর ২৪ বছরের বিরতি। ১৯৯৪ সালে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ে রোমারিও-বেবেতো জুটির অবদানই সবচেয়ে বেশি। বিশ্বকাপে সেলেসাওদের করা ১১ গোলের মধ্যে পাঁচটি রোমারিওর, তিনটি বেবেতোর। ২০০২ বিশ্বকাপ জয়ে রোনালদোর সঙ্গী ছিলেন যেমন রিভালদো। আট গোল করে প্রথমজন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা; পরেরজন পাঁচ গোল নিয়ে দ্বিতীয়তে।
নেইমার-কৌতিনিয়োয় এবার অমন আরেক জোড়া পেয়ে যেতে পারে। ইনজুরি কাটিয়ে প্রথমজন নিজের সেরাতে ফেরার প্রতিশ্রতি দিচ্ছেন মাত্র। পরেরজন ফর্মের তুঙ্গে। আজ মেক্সিকোর বিপক্ষেই হয়তো এই জুটির বারুদে বিস্ফোরণ হবে সত্যিকার অর্থে। ব্রাজিলের স্বপ্নপূরণের জন্য সেটি বড্ড প্রয়োজনও।