বিক্ষিপ্তভাবে পদত্যাগের পর এবার বিএনপিতে গণপদত্যাগ আসছে। বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে বিএনপির ৫০০ সদস্যের যে কেন্দ্রীয় কমিটি তার একটি বড় অংশ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই পদত্যাগের কারণ হিসেবে তারা অন্তত ৭ টি কারণ উল্লেখ করেছেন বলে ঐ সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। যে কারণে এই গণপদত্যাগ হচ্ছে বিএনপিতে, সেগুলো হলো_
১. বেগম খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তার হওয়ার ১ বছরের বেশি সময় পরও তার মুক্তির জন্য বিএনপি আইনগত কিংবা আন্দোলনতগতভাবে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি।
২. ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে বিএনপিকে ভুল পথে পরিচালিত করা হয়েছে। এই নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ছিল ভুল। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করা হয়েছে।
৩. ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর বিএনপি কোন আন্দোলন বা সংগ্রামের কোন দিক নির্দেশনা দিতে পারেনি বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব। যারফলে বিএনপিতে হতাশা বাড়ছে।
৪. জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্তটা বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত। নির্বাচনে ভরাডুবির পরও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বহাল রেখে বিএনপি আরেকটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
৫. বিএনপির নেতৃত্ব তৃনমূলের কথা শুনছে না। তৃনমূলের কথা না শুনে বিএনপির শীর্ষ ৪/৫ জন নেতারা নিজেরা বৈঠক করে সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দলের নিচের দিকের নেতাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন।
৬. তারেক জিয়া বিভ্রান্তিমূলক নির্দেশনা দিচ্ছেন। একের পর এক নির্দেশনা দিয়ে দলকে ভুল পথে পরিচালনা করছেন।
৭. বিএনপির মধ্যে একটি বড় অংশ সরকারের সঙ্গে গোপন আতাত করেছে। গোপন আতাতের মাধ্যমে বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন।
জানা গেছে ৬৪ জেলার প্রায় এক তৃতীয়াংশ সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক এই গণপদত্যাগে অংশগ্রহণ করবেন। এছাড়াও দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক তৃতীয়াংশ সদস্য এই গণপদত্যাগে অংশগ্রহণ করবেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন। এদের মধ্যে স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য রয়েছেন বলেও জানা গেছে। অবশ্য লে. জে. মাহবুবুর রহমান বলেছেন, ‘এমনি তিনি রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে দূরে সরে রয়েছেন। গণপদত্যাগের বিষয়টি সম্বন্ধে তার কোন ধারণা নেই।’ তবে তিনি মনে করেন, বিএনপি জিয়ার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। যেভাবে দল পরিচালিত করা উচিত ছিল সেভাবে দল পরিচালিত হচ্ছে না। একইভাবে দলের আরেক নিস্ক্রিয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াও পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
তবে গণপদত্যাগের যে খসড়া তৈরী করা হয়েছে তার সঙ্গে স্থায়ী কমিটির এই দুই নেতার কোন যোগসূত্রতা নেই বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। তারা পদত্যাগ করছেন ব্যক্তিগত কারণে। তবে তৃণমূলের বিভিন্ন নেতারা পারস্পারিকভাবে যোগাযোগ করে একযোগে পদত্যাগের যে দলিলটি তৈরি করছেন সেই দলিলের মধ্যে বিএনপির ছাড়ার এই কারণগুলোকে উল্লেখ করেছেন এবং এই কারণে তারা পদত্যাগ করছেন বলে দলের সাংগঠনিক এবং দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে একটি সূত্র বলছে যে, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বিএনপির মধ্যে যে মতবিরোধ ও টানপোড়েন সৃষ্টি হয়েছিল, কোনোরকম যাচাই বাছাই কিংবা গঠনতন্ত্র অনুসরণ না করেই যেভাবে বহিষ্কার করা হয়েছিল তাতেই ফুঁসে উঠছে তৃণমূল বিএনপি। সেখান থেকে এই গণপদত্যাগের ধারনাটি এসেছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
উল্লেখ্য যে, বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বিএনপির ওই সিদ্ধান্তকে অমান্য করে বিএনপির একাধিক মাঠ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নেতারা বলছেন এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে দল থেকে ১২৮ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু যারা বহিষ্কৃত হয়েছেন তাঁদের অনেকেই বিএনপির পরীক্ষিত কর্মী এবং দুর্দিনের সঙ্গী। বহিষ্কৃত একাধিক নেতা বলেছেন যে, দীর্ঘ ১২ বছর ধরে তারা জেল জুলুম হুলিয়া মাথায় নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন এবং বিএনপিকে বাচিয়ে রেখেছেন। বিশেষ করে ২০১৪ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিল সে আন্দোলনে এদের প্রত্যেকেরই ভূমিকা ছিল।
তারা মনে করছেন, ২০১৪ তে যারা বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে সারাদেশে আন্দোলন শুরু করেছিল তাঁদেরকে বেছে বেছে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কৃতরা এটাও জানিয়েছেন যে, বহিষ্কার করার ক্ষেত্রে যে গঠন্তান্ত্রিক রীতি সেই রীতি অনুসরণ করা হয়নি। কারণ, একজনকে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বহিষ্কার করতে গেলে তাঁকে প্রথমে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হয় এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু এসব বহিষ্কারের ক্ষেত্রে কোনোরকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়নি। তাছাড়া তাঁদের বক্তব্য হলো যে, উপজেলা নির্বাচন বিএনপি অংশগ্রহণ করার ঘোষণা না দিলেও এই নির্বাচন বর্জন বা বয়কটের কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। এই নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে অংশগ্রহণ করলে কাউকে বহিষ্কার করা হবে এরকম আগাম কোনো সিদ্ধান্তও তৃনমূলে জানানো হয়নি এবং এধরণের সিদ্ধান্ত নিতে গেলে জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকতে হয়। কিন্তু সেটাও বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা করেনি।
একটি সূত্র বলছে যে, মূলত মির্জা ফখরুলের উপর চাপ সৃষ্টির জন্যই এই গণপদত্যাগ তৈরি করা হচ্ছে এবং এর সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অনেক শীর্ষ নেতা জড়িত। তবে এই গণপদত্যাগ যে শেষপর্যন্ত বিএনপিকে আরও দেউলিয়া করে দিবে সে ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কোনো সন্দেহ নেই।